ইন্দোনেশিয়া প্রশিক্ষণের জিও নিয়ে পালিয়েছে সিডনি

বেলাল চৌধুরীর পলায়নে এনবিআর দুদকের অভিনব জালিয়াতি

Any Akter
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৪:৩৬ অপরাহ্ন, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১২:৩৭ অপরাহ্ন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ উপায় সম্পদ অর্জন ও পাচারের অভিযোগে দুদুকে মামলা তদন্ত কালীন আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ভয়াবহ জালিয়াতি ধরা পড়েছে। দুর্নীতিবাজ স্বৈরাচারী সরকারের একনিষ্ঠ দোসর বেলাল চৌধুরীকে বিদেশে পালাতে এনবিআর, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, আদালতের প্রসিকিউশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগ সাজসে কাগজপত্র তৈরি করে আইনের ফাঁক-ফোকরে করে বৈধ পথে পালানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল বিষয়টি নিয়ে গুরুতরভাবে তদন্ত করলে অনেক রাঘববোয়াল এই ঘটনায় জড়িয়ে যেতে পারে। অনুসন্ধানে জানা যায় এন বি আর এর সদস্য মুসক নীতিমালা বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে দলীয় অতি উৎসাহী কর্মী হিসেবে সুবিধা বুগির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের আগে পদোন্নতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন নিয়ে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার অবৈধ উপার্জনের বিষয়টি ছিল আলোচনায়। দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা তদন্ত করছিল। যাতে বিদেশে না পালাতে পারে সেজন্য আদালতের নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিল বেলাল চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার রাতে ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রশিক্ষণের টিম লিডার হিসেবে সরকারের জিও নিয়ে সেখানে না গিয়ে অন্য একটি বিমানে অস্ট্রেলিয়া সিডনি চলে যায়। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে ইমিগ্রেশন পুলিশের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া হয়। আদালতে নিষেধাজ্ঞা ও ও দুর্নীতির মামলা তদন্তকালীনএনবিআরের বেলাল হোসেনের বিদেশযাত্রা নিয়ে পুলিশের ফেসবুক পোস্ট বলা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিদেশযাত্রা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

শুক্রবার পুলিশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিদেশ গমন প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে তার বিদেশ যাত্রারোধে আদালত কর্তৃক গত দুই ফেব্রুয়ারি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরবর্তীতে ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত তাকে বিদেশ গমনের অনুমতি দেন। একই সঙ্গে সরকারি কাজে বিদেশ গমনের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।’

আরও পড়ুন: ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে পাল্টা তলব

পোস্টে আরও বলা হয়, আদালতের আদেশ এবং সরকারি প্রজ্ঞাপনের আলোকে ইমিগ্রেশন পুলিশ তার বহিঃইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ‘আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা হয়েছে’- এই তথ্যটি সঠিক নয়।”। ইমিগ্রেশন পুলিশ বেলাল চৌধুরী বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে আইনি বক্তব্য দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন চলাকালীন পুলিশের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বেলাল চৌধুরীর বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে অবহিত করলেও তারা মৌখিকভাবে অনুমতি দেন। সরকারের অন্য কোন সংস্থা এ বিষয়ে আপত্তি দেয়নি। বোঝা যায় একরকম ম্যানেজ করে বৈধ পথে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে যার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার অর্থ আত্মসাৎ পাচারের মামলার তদন্ত চলমান তাকে কি করে বিদেশে পোস্ট করার জন্য টিম লিডার নিযুক্ত করে। ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আবেদনের প্রেক্ষিতে বেলাল হোসেন চৌধুরী সহ অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও অ্যাম্পিয়ারের ১১ কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদানে বিদেশ যাওয়ার জিউ জারি করা হয়। এটি রহস্যজনক হিসেবে দেখছে সংশ্লিষ্টরা।

দুর্নীতির অভিযুক্ত এই রাজস্ব কর্মকর্তার বিদেশ যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্যোগ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কিভাবে সহজেই সরকারকে ম্যানেজ করে বৈধ পথে বিদেশ পালানোর সুযোগ পেল। ইন্দোনেশিয়ায় সরকারি প্রশিক্ষণের জন্য জিও নিয়ে সেখানে না গিয়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে কিভাবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে গেল তা আরো বেশি রহস্যজনক । এই রহস্য অনুসন্ধানে প্রবাসী অনুসন্ধানে সাংবাদিক জুলকারনাইন সাহেব কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছেন।

আরও পড়ুন: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বদল নয় ডিএমপি’তে সক্ষমতা তৈরির উদ্যোগ

প্রথমত, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তাধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মোঃ বেলাল হোসেন চৌধুরির উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ওভাররাইড করে এবং ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, অর্থমন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, একই ব্যক্তিকে সরকারি কাজে 'ইন্দোনেশিয়া' গমনের জন্যে প্রজ্ঞাপন (GO) জারি করে। 

দ্বিতীয়ত, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রাত ১১টার ফ্লাইটে মোঃ বেলাল হোসেন চৌধুরি ইন্দোনেশিয়ার বদলে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে গমন করেন। এবং তাঁর টিকিটে ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার কোন উল্লেখ নেই। 

তৃতীয়ত, সরকারি প্রজ্ঞাপন (GO) ব‍্যবহার করে, উল্লেখ করা দেশ ব্যতিত অন্যকোন দেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে কেন বেলাল হোসেন চৌধুরিকে ইন্দোনেশিয়ার বদলে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সুযোগ দেয়া হলো? আর কারা এই সুযোগ করে দিলো?  ইমিগ্রেশন পুলিশ, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ, নাকি অন্যকেউ? 

চতুর্থত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কি পরিস্কার রেকর্ডের কর্মকর্তার অভাব যে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে এমন এক কর্মকর্তাকেই বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্যে মনোনয়ন করতে হবে?

 ৫ম, মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজের কান্ডজ্ঞান নিশ্চই আছে? যদি থেকেই থাকে, তাহলে কেন তিনি একজন বেলাল হোসেনের মতো চিহ্নিত একজন দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বিদেশ ভ্রমণের আদেশ ওভাররাইড করে, বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন? ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুমোদিত ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার গভর্নমেন্ট অর্ডার (জিও) ব্যবহার করে, তিনি কিভাবে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ইন্দোনেশিয়ার পরিবর্তে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করলেন? এটা কোন সংস্থার সহযোগীতার কারণে সম্ভব হয়েছে? 

বেলাল সহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ১১জন কর্মকর্তাকে Star Tech Ltd নামক কম্পিউটার যন্ত্রপাতি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমনে অনুমোদন দেয় অর্থমন্ত্রণালয়।  Star Tech Ltd এর চেয়ামম্যান মোঃ রাশেদ আলী ভূঁইয়া, বিগত আওয়ামী লীগের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের ঘনিষ্ঠজন। মোস্তফা জব্বারের সুপারিশে তাকে বাংলাদেশ কম্পিটার সমিতির চট্টগ্রাম শাখার ভাইস প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন।

আওয়ামী সুবিধাভোগী এই প্রতিষ্ঠানটির বিরূদ্ধে রয়েছে মানি লন্ডারিং এর অভিযোগ এবং স্বয়ং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকেই এ বিষয়ে একটি তদন্ত হচ্ছে। এই ধরনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অর্থে বিদেশ ভ্রমণ কতটা যুক্তিসংগত? এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যাতিরকে ইন্দোনেশিয়ায় ভ্রমন ও প্রশিক্ষন খরচ কিভাবে প্রেরণ করা হলো, তাও তদন্ত করা সমীচিন। 

বেলাল হোসেন চৌধুরির বিরূদ্ধে বেনাপোল কাস্টমসে স্বর্ন চুরি, বিট কয়েনের মাধ্যমে অর্থ পাচার, অনুমোদনহীন বিদেশ ভ্রমন, পরিবারের সদস্যদের বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহন, দেশ বিদেশে নামে-বেনামে সম্পদ ক্রয়, লাগামহীন ঘুস গ্রহনের অভিযোগ দুদকের তদন্ত চলমান।  

এই লোক কিভাবে ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার জিও ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়া চলে গেলো এবং কারা তাঁকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করলো, সেসব ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। 

একজন কর্মকর্তা যার বিরুদ্ধে দুর্নীতিদমন কমিশনের তদন্ত চলমান এবং বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আছে, এমন ব্যক্তির নামে কিভাবে অর্থ মন্ত্রণালয় জিও ইস্যু করতে পারে?  আর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা সত্বেও কেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থে সরকারী কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণ করবেন?