নির্বাচনী জোট গঠনে তোড়জোড়

* পাঁচটি শক্তিশালী জোট হচ্ছে:শুরুতেই জামায়াতের জোটে ভাঙন আকিদা বাতিল মতবাদ নিয়ে ইসলামী দলগুলা বিভক্ত
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটযুদ্ধে লড়তে রাজনৈতিক দলগুলো এখন পুরোপুরি জোট গঠনে তৎপর হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের মোকাবেলায় রাজনৈতিক দলগুলো আরও অন্তত চারটি নতুন জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার জন্য এখন মরিয়া বিএনপি ছাড়া অন্যান্য দলগুলো। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বছরপূর্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। নির্বাচনের আগেই সংস্কার ও স্বৈরাচার দোসরদের বিচার অনেকটাই শেষ পর্যায়ে চলে আসছে। নির্বাচন কমিশনের রোড ম্যাপ ঘোষণা ও জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার শেষ পর্যায়ে ভোট যুদ্ধেই সামনে চলে আসছে। নির্বাচনের পিআর পদ্ধতি ও জুলাই সনদের আইনি প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত হলেও নির্বাচনকেই মূল টার্গেট ধরা হয়েছে। ঐকমত্যকমিশন ও সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর আলাপ আলোচনায় বিভক্ত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির সম্ভাবনাই বেশি। জামাত ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকটি দল যুগপত কর্মসূচি দিলেও তলে তোলে নির্বাচনী জোট গঠনের জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা প্রায় ৩০০ আসনেই দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা করেছে। এবি পার্টি এনসিপি ও গণ অধিকার পরিষদ এতদিন জামাতের সাথে থেকে কর্মসূচি পালন করলেও সম্প্রতি হঠাকরে তারা আলাদা হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন: টয়লেট পরিচালনা প্রশিক্ষণে বিদেশ যাচ্ছেন ৩ কর্মকর্তা
এন- সিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামের যুগপ আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ নেই। ইসলামী দলগুলো নিয়ে শুরু থেকে জামাত ইসলামী জোট করার ঘোষণা দিলেও হেফাজতি ইসলাম আমির মাওলানা বাবুনগরীর ইসলামিক দলগুলোকে সতর্ক করায় জমিয়তে উলামা ইসলামসহ কয়েকটি দল জামায়াতের সাথে জোট করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিয়েই নির্বাচনে জোটে লড়তে চায়। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ ইতিমধ্যে এই বিষয়টি খোলাসা করেই বলেছেন, জামায়াতের সাথে তাদের কোন জোট হবে না। জনগণের আস্থা অর্জনে বিএনপি যে কোন রকমের সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত আছে। জামায়াতে ইসলামী গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই ইসলামিক দলগুলোর সাথে যোগাযোগ করে একটি বৃহত্তর জোট করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক আগামী নির্বাচনে লড়তে মূলত পাঁচটি রাজনৈতিক জোট গঠনের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। প্রধানত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সময় দলগুলো আছে।
বিএনপি সাথে হেফাজতে ইসলাম, জমিয়তে উলামা ইসলাম, পার্থর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, এলডিপি, ববি হাজ্জাজ এর দলসহ সমমনা ১২ দলীয় জোট আছে। বিএনপি সূত্র জানায়, বিএনপি গত ১৭ বছরে আন্দোলনে থাকা জামায়াত ইসলামী ছাড়া সকল দলকে পার্টি, নুরুল হক নুরুর নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদ ও সাবেক শিবির সভাপতি মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন এবি পার্টি এতদিন জামায়াত ইসলামের নেতৃত্বেই ছিল। পিআর পদ্ধতি নির্বাচন ও জুলাই সনদের আইনিভিত্তি নিয়ে যুগপ আন্দোলনে অনেকেই জামায়াতের পাশে নেই। চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ও মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও জামায়াতের সাথে নির্বাচনী জোটে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেনি। ইসলামিক দলগুলোর লিয়াজোভিত্তিক বৃহত্তর ঐক্যের সংগঠন হেফাজতে ইসলাম আমির মাওলানা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী জামাত ইসলামি ও চরমোনাই পীরের দলের বিরুদ্ধে ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাসের অভিযোগ এনে তাদের সাথে ইসলামের দলগুলোর কোন জোট না করার সতর্কতায় পুরোই পাল্টে যায় জামাতের নেতৃত্বে ইসলামী দলগুলোর জোট। এরমধ্যে গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি, কোন অধিকার পরিষদ ও এবি পার্টিসহ কয়েকটি দল জুলাই চেতনা ধারণা করে একটি নতুন জোট করতে ত- পরতা চালাচ্ছে। এই জোটের সাথে বিএনপি জোটের আসন সমঝোতার বিষয়টিও আলোচনায় আছে। সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলো আরেকটি নতুন জোটের আলোচনায় আছে। তবে নিষিদ্ধ নিবন্ধন স্থগিত হওয়া আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও কারাগার থেকে তাদের অনেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার তপরতা চালাচ্ছে। সবচেয়ে আলোচনায় এসেছে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। মহাসচিব শামীম পাটোয়ারী জাতীয় পার্টির একটু জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য সমমনা কয়েকটি দলের সাথে আলোচনা চালাচ্ছেন। এই জোটে আওয়ামী লীগের অনেক বিদ্রোহী ও সতন্ত্র প্রার্থী অংশ নিয়ে আসন সমঝোতায় যেতে পারে।
আরও পড়ুন: ৩৯ পরিদর্শককে সহকারী পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি
আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে নতুন পথে রাজনীতি। নানা ইস্যুতে কয়েকটি দল আন্দোলন নিয়ে রাজপথে থাকলেও ভেতরে ভেতরে তারাও নির্বাচনমুখী। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে ভোটের হিসাব-নিকাশও। নির্বাচনী জোট গঠনেও পর্দার আড়ালে চলছে নানা আলোচনা ও তৎপরতা। কোন দল কোন জোটে যাবে, তা নিয়েও জনমনে কৌতূহল রয়েছ । জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার কোনো দলের এককভাবে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা হয় জোট, না হয় আসন সমঝোতা করে ভোটে অংশ নেওয়ার পক্ষে।
দলগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত যেটুকু তৎপরতা তা থেকে জানা যায়, সমমনা দল ও জোট নিয়ে বিএনপি একটি বড় জোট করতে পারে। পাশাপাশি কয়েকটি দলের সঙ্গে আসন সমঝোতাও হতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডক্টর মাহবুব উল্লাহ বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অতীতে রাজনৈতিক দলগুলি জোট করেছে এবারও যোগ করতে পারে। অথবা আসন ভাগাভাগি করতে পারে। এটি হওয়া স্বাভাবিক বিষয়। এদিকে এবারের নির্বাচন সহজ নয়-এমনটা ধরে বিএনপিও নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা হিসাব-নিকাশ করছে। বিএনপি কোন ফরম্যাটে বা কাঠামোতে জোট করবে, তা নিয়ে এখন বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। তবে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোকে সঙ্গে নিয়েই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে-দলগুলোর মধ্যে এমন আলোচনা আছে।
জানা গেছে, জোট গঠনে অনেকটাই নির্ভার দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি। অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দলটি এবার ডান-বাম ও ইসলামি দলগুলোকে একসঙ্গে নিতে চায়। দলগুলো হলো-লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণফোরাম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) নেতৃ ত্বাধীন ১২ দলীয় জোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বাধীন জাতী- য়তাবাদী সমমনা জোটের ১১টি দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি ইসলামি দলও বিএনপির সঙ্গে জোটে যুক্ত হতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি দল অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামেও যুক্ত। এছাড়াও এনসিপি নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির। অন্যদিকে, জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলগুলোও বসে নেই। জামায়াত জোট কিংবা আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেবে-এটা অনেকটা নিশ্চিত। ইতোমধ্যে জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনসহ নানা দাবিতে জামায়াতসহ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাগপা অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন করছে। তবে জামায়াত কাদের সঙ্গে জোট করছে তা নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে বা পরে স্পষ্ট হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ইসলামপন্থি দলগুলো যাতে এক জায়গায় থাকতে পারে সেই চেষ্টা করছি। আলাপ-আলোচনা চলছে। ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, 'প্রতিটি আসনে ইসলামপন্থিদের একক প্রার্থী দেওয়ার আলোচনা চলছে। সবাই পজিটিভ। সেটা নির্বাচনি আসন সমঝোতাও হতে পারে।' জানা গেছে, এনসিপি জোট গঠন করলে তাতে এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি দলকে দেখা যেতে পারে। তবে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জোট নিয়ে দলে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এদিকে নির্বাচনের আগে বাম ধারার সব দল ও সংগঠনকে নিয়ে একটি জোট গঠনে তৎপর রয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।
এই জোটে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ছয় দল-বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, সমাজতান্ত্রিক পার্টি ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ থাকছে। এর বাইরে আদিবাসী সংগঠন, দলিত সংগঠন এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে জোটে ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, 'আমরা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বদল চাই। বিগত সময়ে শাসক দলগুলোকে আমরা দেখেছি। তাই বিকল্প জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।'