সারাদেশে সর্বোচ্চ সতর্কতায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হঠাৎ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ে তোলপাড়

মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রামে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। জুলাই সনদ স্বাক্ষর, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে দেশে অস্থিরতা তৈরিতে কোনো মহলের নাশকতা আছে কিনা খতিয়ে দেখছে। এদিকে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সারাদেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা রাখা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শনিবারের অগ্নিকাণ্ড, রুপনগর কেমিক্যাল গোডাউনের অগ্নিকাণ্ড ও চট্টগ্রামে ইপিজেডের আগুনের ঘটনায় পরিকল্পিত মনে করছে সরকার। এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এগুলোকে পরিকল্পিত নাশকতা হিসেবে উল্লেখ করে তদন্ত করে দোষীদের বিচার দাবি করেছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে একটি বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা গভীরভাবে অবগত। আমরা সকল নাগরিককে আশ্বস্ত করতে চাই নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে।
আরও পড়ুন: শাহজালাল বিমানবন্দরে রাত ৯টা থেকে ফ্লাইট চলাচল পুনরায় শুরু
নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না।
আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই—যদি এসব অগ্নিকাণ্ড নাশকতা হিসেবে প্রমাণিত হয়, এবং এর উদ্দেশ্য হয় জনমনে আতঙ্ক বা বিভাজন সৃষ্টি করা, তবে তারা সফল হবে কেবল তখনই, যখন আমরা ভয়কে আমাদের বিবেচনা ও দৃঢ়তার ওপর প্রাধান্য দিতে দেব।
আরও পড়ুন: শাহজালাল বিমানবন্দরের আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে
বাংলাদেশ অতীতেও বহু কঠিন সময় অতিক্রম করেছে। আমরা ঐক্য, সংযম ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আমাদের গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে যেকোনো হুমকির মোকাবিলা করব। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এসব অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। ছাই হয় অনেকের স্বপ্ন। মুহূর্তেই পুড়ে যায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ। ধারাবাহিক এসব অগ্নিকাণ্ড পরিকল্পিত নাকি নিছক দুর্ঘটনা; এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে।
তথ্যমতে, ১৪ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত রাজধানীতে ভয়াবহ দুটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এর একটি মিরপুরের শিয়ালবাড়ির রাসায়নিকের গুদামে ও আরেকটি বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে। আর ১৬ অক্টোবর আগুন লাগে চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকার একটি তোয়ালে কারখানায়। সবশেষ বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে শনিবার দুপুর সোয়া ২টায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট। একইসঙ্গে ঘটনাস্থলে রয়েছেন নৌ-বাহিনী, বিমানবাহিনী, সিভিল অ্যাভিয়েশন, দুই প্লাটুন বিজিবিসহ পুলিশ-আনসারের সদস্যরা। সন্ধ্যা নাগাদ আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছেন বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালকের মুখপাত্র মো. মাসুদুল হাসান মাসুদ। তবে পাঁচ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পুরোপুরি নেভানো যায়নি এ আগুন।
সূত্র বলছে, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজটি মূলত পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি জায়গায় বা আট নম্বর গেটের পাশে। আর আগুন লেগেছে আমদানির কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে। এখানে আমদানি করা পণ্য রাখা হয়। আগুনে সেখানকার প্রায় সব মালামাল পুড়ে গেছে বলে জানা গেছে। এতে বড় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, ভয়াবহ আগুনের কারণে বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে ঢাকার বদলে সব বিমান চট্টগ্রাম ও সিলেটে অবতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে আটটি ফ্লাইট চট্টগ্রামে, তিনটি ফ্লাইট সিলেটে, চেন্নাই ও দিল্লি থেকে দুটি ফ্লাইট কলকাতায় অবতরণ করে। এছাড়া ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও আটকে আছে ট্যাক্সিওয়েতে।
জানা গেছে, ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরগামী বাটিক এয়ারের ওডি-১৬৩ ফ্লাইট এবং ঢাকা থেকে মুম্বাইগামী ইন্ডিগোর ৬ই-১১১৬ ফ্লাইট ট্যাক্সিওয়েতে অপেক্ষা করছে। ব্যাংকক থেকে ঢাকায় আসা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি অবতরণ করেছে চট্টগ্রামে। দিল্লি থেকে ঢাকা আসা ইন্ডিগোর ফ্লাইট অবতরণ করেছে কলকাতায়। এয়ার এরাবিয়ার শারজাহ থেকে ঢাকা আসা ফ্লাইট চট্টগ্রামে অবতরণ করেছে। হংকং থেকে ঢাকা আসা ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের বিমানটি অবতরণ না করতে পেরে চক্কর দিচ্ছে আকাশে।
বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা জানান, বিমানবন্দরের কার্যক্রম যেন ব্যাহত না হয়, সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কার্গো ভিলেজ এলাকায় আগুন লাগলেও যাত্রী টার্মিনালে তেমন প্রভাব পড়েনি। তবে যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিমান চলাচল সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এলে ফ্লাইট চলাচল স্বাভাবিক করা হবে।
তথ্যমতে, আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার ফাইটার, সিভিল অ্যাভিয়েশন, আনসারসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৭ জনই আনসার সদস্য বলে জানিয়েছেন আনসার ও ভিডিপির গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. আশিকুজ্জামান।
তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে আমাদের এক হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের ৯ জনকে সিএমএইচে ও বাকিদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তাহলা বিন জসিম বলেন, খবর পেয়ে দুপুর ২টা ৩৪ মিনিটে শুরুতে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট। পর্যায়ক্রমে আরও ইউনিট যোগ হয়ে মোট ৩৭টি ইউনিট কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও জানা যায়নি। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত জানানো হবে।
দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে আগুন লাগার ঠিক দুদিন আগে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) এলাকার একটি কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অ্যাডামস তোয়ালে, ক্যাপ, জিহং মেডিকেল সার্জিক্যাল গাউন তৈরির ওই সাততলা ভবনটি থেমে থেমে জ্বলতে থাকে আগুন। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। মূলত ভেতরে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন নেভাতে বেগ পোহাতে হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন।
মিরপুরের শিয়ালবাড়ি এলাকায় পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে আগুনে প্রাণ হারান ১৬ জন। দগ্ধ হন আরও অনেকে। শিয়ালবাড়িতে চারতলা ভবনে থাকা ‘আনোয়ার ফ্যাশন’ পোশাক কারখানা ও পাশে থাকা টিনশেড ঘরে রাসায়নিকের গুদামে এ আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী।