ভোট : সবার দৃষ্টি এখন যমুনায়

একইদিনে নির্বাচন ও গণভোটে ৩ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের চিন্তা

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১০:০৪ অপরাহ্ন, ৩১ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ৬:৫০ পূর্বাহ্ন, ০১ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

জাতীয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ ও গণভোটের সময় নিয়ে শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল হলেও ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খুবই অনড়। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা ও রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিতে চায় সরকার। শেষ মুহূর্ত গণভোটের সময় ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি আদেশের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই উদ্যোগী হয়ে আবারো রাজনৈতিক সর্বদলীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেবেন। দেশের রাজনৈতিক অনৈক্যের উত্থান এই পরিস্থিতিতে সবার দৃষ্টি এখন প্রধান উপদেষ্টার সময়োচিত পদক্ষেপের প্রতি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতি নির্ধারণী ফোরাম ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বস্ত সূত্র জানা গেছে, রাজনীতিতে বিতর্ক অনৈক্য মতবিরোধ হোক ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। সরকার রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।  রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন রাজনৈতিক মাঠ গরম করে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ দর কষাকষি করে সুযোগ নিতে চায়।  বিএনপি যেহেতু বড় দল এবং ক্ষমতা যাওয়ার প্রধান আশাবাদী তাই অন্য দলগুলো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে ভোটের মাঠে একটি ভারসাম্য আনতে চায়। সূত্র জানায় প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে গণভোট, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রধান উপদেষ্টা কাউন্সিলের খুব দ্রুতই একটি সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গতকাল শুক্রবার নোয়াখালীতে এক অনুষ্ঠানে ফেব্রুয়ারি নির্বাচন দৃঢ় প্রত্যায় ব্যক্ত করে বলেন সংকট নিরসনে  প্রধান উপদেষ্টা দ্রুত উদ্যোগ নিচ্ছেন।

তিনি বলেন, গণভোট ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা সিদ্ধান্ত নেবেন। যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক না কেন, নির্বাচন ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই হবে।

আরও পড়ুন: বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের পথ সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে: মির্জা ফখরুল

গতকাল শুক্রবার দুপুরে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই কন্যা ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

শফিকুল আলম বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতের কথা বলছে। আমরা এটাকে হুমকি হিসেবে দেখছি না। যেটা সবচেয়ে উত্তম, প্রধান উপদেষ্টা সেটাই করবেন।

আরও পড়ুন: ১৫ বছরের জঞ্জাল ১৫ মাসে পরিষ্কার সম্ভব নয়: ধর্ম উপদেষ্টা

তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচারের পতন ও গণঅভ্যুত্থানে পুরুষ ও নারীরা একসঙ্গে রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। এখন আর নারীরা পিছিয়ে নেই। সব ক্ষেত্রেই তারা প্রতিনিধিত্ব করছে।’

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন দলের পরস্পরবিরোধী এই অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলগুলোর মতভিন্নতা ও মেরুকরণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়- এই সংকট থেকে উত্তরণের কোনো সহজ বা বিকল্প পথ খোলা নেই। দলগুলোর মধ্যে কার্যকর ঐক্য ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ছাড়া এই অচলাবস্থা নিরসন অসম্ভব। গণভোটের চেয়ে বেশি জরুরি সর্বসম্মত বাস্তবায়নের রোডম্যাপ।

৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশসহ ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করা হয়। গত ১৭ অক্টোবর সংসদ ভবন চত্বরে জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়। এরই মধ্যে ২৫টি দল ও জোট জুলাই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু সমস্যা বেঁধেছে সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে গত মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা। এতে বলা হয়েছে, ৪৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। আর গণভোট হবে একটি প্রশ্নে। সমস্যা তৈরি হয়েছে, দলগুলোর দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ গণভোটে না রাখার সুপারিশ নিয়ে। বিএনপি বিষয়টিকে রাজনৈতিক দল ও জাতির সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে দেখছে।

সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে যে সুপারিশ দিয়েছে, তা ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছে বিএনপি। গতকাল দুপুরে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যেসব বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আসেনি, তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

মির্জা ফখরুল বলেন, গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা শুধু আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু সেদিন সনদের চূড়ান্ত কপি আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। পরে প্রিন্টেড পুস্তক হিসেবে সনদের কপি আমরা হাতে পাওয়ার পরে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে পুনরায় সংশোধন করা হয়েছে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘আদেশ জারি’র এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের আদেশ জারির কোনো ক্ষমতা নেই। সংবিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার শুধু নির্বাচিত সংসদের।

অপরদিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জামায়াত রাষ্ট্র সংস্কারে দেওয়া ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। সে জন্য দ্রুত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। গণভোটের পরে ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে উল্লেখ করে ডা. তাহের বলেন, এমন কোনো বিষয় যাতে সামনে আনা না হয়, যে কারণে নির্বাচন সংশয় বা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। জাতীয় নির্বাচনের জন্য ফেব্রুয়ারিই উপযুক্ত সময়।

এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপির বর্তমান অবস্থানকে তীব্র সমালোচনা করেছে এনসিপি। দলটি মনে করে, সনদের আইনি ভিত্তি স্পষ্ট না করে স্বাক্ষর করা বিএনপির ঠিক হয়নি। গতকাল এক অনুষ্ঠানে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, “বিএনপি অনলাইনে ‘না’ শব্দ জারি করলেও তাদের ‘না’ বলার কোনো ওয়ে নেই। কারণ তারা অলরেডি ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছে। তারা বিবাহে রাজিও হয়েছে, কাবিননামায় সইও করেছে। এখন তাদের না বলার কোনো অপশন নেই।” 

জাুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গনভোট নিয়ে মূলত বিএনপি জামায়াত ও এনসিপি রাজনৈতিক মাঠ গরম করলেও অন্যান্য দলগুলোও তাদেরও অনুসরণ করছে। রাজনৈতিক মাঠ হঠাৎ উত্তপ্ত হওয়ার পরিস্থিতি বিশ্লেষকদের মতে, সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে এই ভিন্নমতগুলো রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। গণভোটের সময়, বাস্তবায়নের আইনি পদ্ধতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা নিয়ে এই মতানৈক্য জুলাই সনদের ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ঐকমত্য কমিশন কীভাবে সব দলের জন্য গ্রহণযোগ্য সমাধান আনবে, সেদিকে সবার নজর রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণতন্ত্রচর্চা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. আইনুল ইসলাম বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, এরপর সরকার এবং তারপর আরও ২৭০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে সনদ বাস্তবায়নের জন্য। এত দীর্ঘসময়ের ফলে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী জুলাই সনদ নিয়ে জনগণের মধ্যে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তাতে গুড়েবালি হতে পারে। আর জাতীয় নির্বাচনের পর সনদ নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হলে তার ভবিষ্যৎ কী হবে- সেটা অজানা।

জাতীয় র্নিবাচন , গণভোট ও জুলাই সদন বাস্তুবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভক্তির চাপ মাঠে পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ আলোচনার পরও অনৈক্যে সরকার চাপে পড়েছে সত্য। তবে প্রধান উপদেষ্টা দ্রুতই জাতির কল্যাণে সময়োচিত সিদ্ধান্ত নেবেন।