ওমরা করতে ছুটি নিয়ে পদত্যাগ রহস্য

ট্যারিফ কমিশন চেয়ারম্যান মইনুল খান কি পালিয়েছেন

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৬:৫৮ অপরাহ্ন, ১৪ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৭:১০ অপরাহ্ন, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিগত ১৫ বছরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও আলোচিত কর্মকর্তা বাংলাদেশ ট্রেড ও ট্যারিফ কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মইনুল খানের হঠাৎ পদত্যাগ নিয়ে সর্বত্র রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। বিগত ১৫ বছর ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে ৫ আগস্টের পর ডাবল পদোন্নতি নিয়ে সচিব মর্যাদায় কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ায় আলোচনায় আসে মইনুল খান। এনবিআরের দুর্নীতির বরপুত্র হিসেবে পরিচিত মইনুল খানের একটি রক্তক্ষয়ী ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পর কিভাবে দুই দফা পদোন্নতি পেলেন, তা নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

বিভিন্ন অভিযোগে নড়েচড়ে উঠে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়। দশ বছর আগে থেকেই তার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধ উপার্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি স্বার্থ বিনষ্ট, এবং শীর্ষ ব্যবসায়ীদের হয়রানি করার অসংখ্য অভিযোগ বিদ্যমান।

আরও পড়ুন: যারা ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাদের কাছে দেশ নিরাপদ নয় : সালাম আজাদ

চারদিকে তীব্র ক্ষোভ ও অভিযোগের অনুসন্ধান পরিস্থিতি বুঝেই চাকরির মেয়াদ ১০ মাস বাকি থাকতেই বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। তবে পদত্যাগ তিনি স্বাভাবিকভাবে করেননি। পবিত্র উমরা করার জন্য সরকার থেকে ছুটি নিয়ে সৌদি আরব যান। চাকরিতে কি ইস্তফা গোপন রাখা হয়, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, পবিত্র উমরা আদায় করে দেশে না ফিরে তার দ্বিতীয় নিবাস অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। চাকরি থেকে পদত্যাগের কাগজ পাঠান অফিসে ৬ নভেম্বরের তারিখে। তারই রহস্যজনক পদত্যাগ ঘিরে চলছে নানা আলোচনা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছর ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার তাকে সচিব পদমর্যাদার ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের এ পদে নিয়োগ দিয়েছিল। আগামী বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার চাকরির মেয়াদ ছিল। এখনো ১০ মাস বাকি থাকা সত্ত্বেও তার এ পদত্যাগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে পাটভিত্তিক উৎপাদনে বড় বিনিয়োগে আগ্রহী চীন

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাপক সুবিধাভোগী এ কর্মকর্তাকে ৫ আগস্টের পর তড়িঘড়ি করে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দিয়ে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এদিকে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান একাধিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মইনুল খান আগেই জানিয়েছিলেন যে তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে চান। সম্প্রতি তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েও তার একটি অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।

মইনুল খান গত ২০ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা সরকারি আদেশ (জিও) অনুযায়ী ২৬ অক্টোবর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ২০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছেন।

বিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, অফিসের গ্রুপে তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। ওই গ্রুপে সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি সরকারি চাকরি থেকে ঐচ্ছিক অবসরের সিদ্ধান্তের কথা জানান। সেখানে তিনি তার চাকরিজীবনের প্রায় ৩২ বছরে সরকারের বিভিন্ন পদে ও স্থানে পেশাদারিত্বের সঙ্গে চাকুরীর কথা উল্লেখ করেন।

কী কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন, তা নিয়ে অফিসের কেউ কথা বলেননি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ড. মইনুল খানের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে কল করে ও বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।

তাকে সচিব পদমর্যাদায় পদোন্নতি দিতে গিয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতির ১০ শতাংশ কোটায় এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে’। এতে আরও বলা হয়, বর্তমানে এনবিআরের সদস্য (গ্রেড-১) হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মইনুল খান অবসরের আগে নিজ ক্যাডারে ফিরে যাবেন।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী। কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও তার বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) একাধিকবার তদন্ত শুরু হলেও তা মাঝপথে থেমে যায়।

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী মতের ব্যবসায়ীদের দমন করার অন্যতম কারিগর ছিলেন মইনুল খান। কাস্টমস ক্যাডারের এ কর্মকর্তা শুল্ক গোয়েন্দা ও ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে বিএনপি-সমর্থক ব্যবসায়ীদের আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সাফাই গাইতে বাধ্য করতেন। কেউ রাজি না হলে ওই ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের ফাইল অডিটে ফেলে শতকোটি টাকার শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকির মামলা দিয়ে মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করতেন। এতে তিনি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রশংসা কুড়াতেন।

এনবিআর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগপ্রাপ্ত শীর্ষ কর্মকর্তাদের খুশি করতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। ফলে চাকরিজীবনে কখনো খারাপ জায়গায় পোস্টিং পাননি। শুল্ক গোয়েন্দা, ভ্যাট গোয়েন্দা ও ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেটে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ ব্যাচের জ্যেষ্ঠ তিন কর্মকর্তাকে পেছনে ফেলে এনবিআরের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে হয়তো নিজের ‘ম্যানেজমেন্ট কারিশমা’ দিয়ে, নয়তো ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে।

কাস্টমসের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, জুয়েলারি শিল্প মালিকরা ছিলেন মইনুল খানের অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস। ঘুষের লেনদেন হতো অস্ট্রেলিয়ায়। ২০১৭ সালে বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় জনরোষকে কাজে লাগিয়ে আপন জুয়েলার্সের সব শোরুমে একযোগে অভিযান চালায় শুল্ক গোয়েন্দা। পরে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে আপন জুয়েলার্সকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া সোনা চোরাচালান তদন্তের নামে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা ছিল তার নেশা। আপন জুয়েলার্সে অভিযানের পর তটস্থ স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বিনাবাক্যে তার নির্দেশে ঘুষ দিতেন।

পরে ভ্যাট গোয়েন্দায় দায়িত্ব পালনকালে আরেক জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডকে অডিটে ফেলেন তিনি। মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে সামান্য ভ্যাট আদায়ের নাটক সাজিয়ে তদন্ত রফাদফা করা হয়।

তবে আওয়ামী লীগ আমলে যেভাবে প্রভাবশালী ছিলেন, ঠিক একইভাবে দুর্নীতিতেও অগ্রগামী। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও তিনি নিজের ক্ষমতার ভেলকি দেখান। প্রশাসনে বড় ভাইয়ের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ২৮ আগস্ট আগের মতো জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। মাত্র ১০ দিন পর তাকে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এটি কাস্টমসের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এনবিআরের ইতিহাসে শুধু আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, গ্রেড-১ পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও তাকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। এনবিআরের অর্গানোগ্রামে কাস্টমসের তিনটি গ্রেড-১ পদ রয়েছে। কিন্তু দুটি পদে গ্রেড-১ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এনবিআরের প্রথা ভেঙে মইনুল খানকে তৃতীয় কর্মকর্তা হিসেবে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তার জ্যেষ্ঠ দুই কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক থাকাকালে তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের ক্যাশিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। শুল্ক গোয়েন্দার সোর্স মানির টাকায় নজিবুর রহমানকে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে ৫ কোটি টাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনে দেন।

মুখ বন্ধ রাখতেও মইনুলের ঘুষ খাওয়ার অভ্যাস ছিল। ভ্যাট গোয়েন্দায় থাকাকালে পুরান ঢাকার প্রতিষ্ঠান নাহিদ এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির মামলা করেন। তখন গণমাধ্যমে প্রচার করে বাহবা নেন। পরবর্তীকালে পদোন্নতি পেয়ে ভ্যাট বাস্তবায়ন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নাহিদ এন্টারপ্রাইজের মালিক ভ্যাট ফাঁকির মামলা থেকে বাঁচতে তৎকালীন ঢাকা (দক্ষিণ) ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনারের পরামর্শে ড. খানের সঙ্গে দেখা করেন। ড. খান নীরব থাকার প্রতিশ্রুতি দিলে কমিশনার ২৫ কোটি টাকায় ২৭৫ কোটি টাকার ভ্যাট রফাদফা করেন। এই টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা ড. খানকে দেওয়া হয়।

নীরব দর্শকের ভূমিকায় দুদক: এর আগে একাধিকবার ড. মইনুল খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করলেও তা শেষ করতে পারেনি দুদক। ‘ম্যানেজ মাস্টার’ ড. খান নিজের এবং বড় ভাইয়ের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মাঝপথেই অনুসন্ধান বন্ধ করে দেন। ২০১৯ সালে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হলেও তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ মইনুল খানের দুর্নীতির অনুসন্ধান চেয়ে একজন আইনজীবী রিট করেছেন।

দুদক বরাবরের দেওয়া আইনজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের আবেদনে জানা যায় মইনুল খান দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে চাকুরী কালীন সরকারি সার্থ ক্ষুন্ন করে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে বিপুল অবৈধ উপার্জন করেছেন। তার অবৈধ উপার্জিত বেশিরভাগ টাকাই তিনি বিভিন্ন সময়ে অস্ট্রেলিয়া আর করেছেন মর্মে অভিযোগ রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় তার পরিবারের সদস্যরা এভাবে বসবাস করে বলে জানা গেছে। তিনিও উমরার ছুটি নিয়ে চাকরি ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় তাই এভাবে বসবাসের জন্য পারি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে।