অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার, বিচার দাবি

ডিবি হাজতে নির্যাতনে দুই ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে জনমনে ক্ষোভ

Sadek Ali
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ৮:৪৮ অপরাহ্ন, ২২ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৮:৫৩ অপরাহ্ন, ২২ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে গোয়েন্দা পুলিশ হেফাজতে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে আটক দুই ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় জনতা ও মানবাধিকার কর্মীগণ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গন অভ্যুত্থানের মত পট পরিবর্তনের পরও পুলিশের এরকম আচরণে সবাই হতবাক। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো পুলিশের প্রতি তীব্র অ সন্তোষ প্রকাশ করে অবিলম্বে পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও তাদের অনৈতিক কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানান। এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মুক্তার হোসেন ও শাহাদাত কে হারিয়ে দুটি পরিবার এখন অকুল পাতারে। আপন জনের মৃত্যুর শোকের চেয়ে ভয়ংকর বিষয় হয়েছে দুই পরিবারের প্রতি পুলিশের হুমকি।  ঢাকার গোয়েন্দা হাতে হেফাজতে নির্যাতন নিহত পল্লবীর ব্যবসায়ী মুক্তার হোসেনের স্ত্রী মুক্তা বেগম শনিবার স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সংবাদ সম্মেলন ডাকলেও পুলিশি বাধার মুখে যেতে পারেননি। মুক্তা বেগম বলেন স্বামীকে পুলিশ মেরেছে এখন আমার একমাত্র ছেলেকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। ছেলেকে বাঁচাতে হলে কোন মামলা দিতে পারবি না। কোথাও কথা বলতে পারবি না। বাসায় অবরুদ্ধ অবস্থায় আছি। এদিকে সিরাজগঞ্জে গোয়েন্দা হেফাজতে ভ্যানচালক শাহাদাতের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এলাকায় বিক্ষোভ চলছে।

নিহতের স্বজনরা জানান, তাকে আটকের পর পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছিল। টাকা না দেওয়ায় ওসি সিদ্দিকের নেতৃত্বে তাকে হত্যা করা হয়।

আরও পড়ুন: শীশা বারে হত‍্যাকাণ্ডের জেরে চাঁদার হার দ্বিগুন করেছেন বনানী থানার ওসি

অনুসন্ধানে জানা যায়, ডিবি হাজতে নির্যাতনের দুটি ঘটনাকেই অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কারণ পুলিশ দাবী করলেও তাদের শরীরের সর্বাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে। পরিবারের দাবি টাকার জন্য উল্টা বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন করেছে পুলিশ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের নির্বাহী পরিচালক নাসিরুদ্দিন এলান ডিব্বি হেফাজতে সন্দেহজনক আটক করে দুই ব্যক্তিকে নির্যাতন করে হত্যার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন গোয়েন্দা পুলিশের এসব ঘটনা কোনভাবেই মানা যায় না। ঘুসের জন্য নির্যাতন এখনো আমাদের শুনতে হবে এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।  ভুক্তভোগী পরিবারের সংবাদ সম্মেলনের বাধা দেয়ার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি হত্যাকারী পুলিশ সদস্য ও বাধাপ্রদানকারী পুলিশ সদস্যদের বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের এসব আচরণেই জনমনে তীব্র সন্তোষ ছিল। জনতার বিক্ষুব্ধতায় তারা মনোবল হারিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও অপারেশনে দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু তাদের এখন কর্মকাণ্ড দুঃখজনক মানবাধিকার ও নৈতিকতা পরিপন্থি। 

তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম খান জানান বিষয়টি নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি কাজ চলমান আছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। এদিকে আলোচিত ডিবি কার্যালয়ের হাজতে গণপিটুনিতে আহত হওয়ার পর মৃত্যুর দাবি করলেও পরিবার বলছে পুলিশ তাকে আটকের পর প্রকাশ্যে মানুষের সামনে নির্মম নির্যাতন করেছে। গুরুতর আহত হলেও তাকে কোন চিকিৎসা করতে দেয়া হয়নি। তার সামনেই তার কলেজ পরুয়া ছেলেকে অমানুষিক নির্যাতন করেছে। পিতা পুত্র কে ধরে নির্যাতনের পর ডিবি হাজতে আলাদা রেখে দেয়। সকালে পিতা মুক্তার কে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অতিরিক্ত নির্যাতনে কোন চিকিৎসা না করায় মুক্তারের মৃত্যু হয় বলে পরিবারের দাবি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তার স্ত্রী অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার করে বিচারের দাবি করেছেন। ডিবি কার্যালয়ে হাজত খানায় রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হওয়া যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া হত্যার সন্দেহজনক আসামি নিহত মুক্তার হোসেনকে মিরপুরের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তার মৃত্যুর খবর প্রথমে জানানো হয় একই হাজত খানায় অন্য রুমে আটক এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া ছেলে মামুন হোসেন মৃদুল কে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিতার মৃত্যুর খবর দিয়ে ডিবির হাজত খানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর পরিবারের সদস্যরা আসে ডিবি কার্যালয়। তাদের সাথে ডিবি কর্মকর্তাদের চরম দুরব্যবহারের অভিযোগ করেছেন নিহতর স্ত্রী মুক্তা বেগম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গোয়েন্দা হাজত থেকে মুক্ত মামুন হোসেন মৃদুল জানায় পিতা মুক্তার হোসেনকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ধ ব্লকের বাসার সামনে থেকে ডিবি পুলিশ আটক করে গাড়িতে তুলে। গাড়ির ভিতরে আমাদের সামনেই পুলিশ তাকে অমানবিকভাবে লাঠিপেটা করে। গাড়িতেই তিনি গুরুতর আহত হয়ে পড়েন। আমি এবং আমার মা এ সময় তাকে আটক ও নির্যাতনের কারণ জিজ্ঞেস করলে পুলিশ আমাকেও ধরে সকলের সামনে লাঠিপেটা দেয়। আমার পিতার সামনে আমাকে নির্মমভাবে লাঠিপেটা করায় বাবা অজুড়ে কাঁদছিলেন। এতেই পিতা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃদুল আরো জানান আমাকে পিটানোর পর অন্য একটা গাড়িতে গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নেয়। দীর্ঘ সময়ে তারা এখানে আমাদের আটকে রেখে সিনিয়র অফিসার আসার কথা বলে আমাদের নির্যাতন করে। রাতে আমাকে ডিবি হাজতে নিয়ে লাঠিপেটা করে অন্য রুমে থাকতে দেয়। সকালে আমাকে জানানো হয় অসুস্থ হয়ে আমার পিতা মারা গেছে। আমার পিতার উপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর কোন চিকিৎসা করতে দেয়নি। নিহতের স্ত্রীর মুক্তা বেগম বলেন গোয়েন্দা হেফাজতে আমার স্বামীকে হত্যার বিষয়ে পল্লবী থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ কোন মামলা নেয় নাই। 

আরও পড়ুন: এসপি হতে ৫০ লাখ টাকা ঘুষের অভিযোগে পুলিশ সুপারকে দণ্ড

এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ মুক্তার হোসেন মৃত্যুর বিষয়ে শুক্রবারের একটি প্রেস রিলিজ দিয়েছে গণমাধ্যম গুলোতে। তাতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় আটক ব্যক্তির মৃত্যু প্রসঙ্গে পোলাপাইন রাজধানীর পল্লবীতে কয়েকজন অস্ত্রধারীর এলোপাতাড়ি গুলিতে গোলাম কিবরিয়া নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। এ ঘটনায় পাঁচ জন এজাহারনামীয় ও ৭/৮ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের লক্ষ্যে মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। এই প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ঘটনার সাথে জড়িত নজরুল, মাসুম ও জামান নামে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করে এবং ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি জনৈক মো: মোক্তার হোসেনের হেফাজতে আছে মর্মে জানায়। তাদের কাছে পাওয়া তথ্য মোতাবেক মোক্তারকে আটক করতে ডিবির একটি টিম বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) সন্ধ্যা  আনুমানিক ০৬.০০ ঘটিকার সময় রাজধানীর পল্লবী এলাকায় একটি গ্যারেজে অভিযান পরিচালনা করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় কৌশলে তাকে আটক করা হয়। এ সময় উত্তেজিত জনতা তাকে কিল-ঘুষি মারে। পরবর্তীতে মোক্তারের দেখানো মতে পল্লবী এলাকার একটি রিকশা গ্যারেজ থেকে আট রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার করে ডিবি।

আটককৃত মোক্তার হোসেনকে (৪০) পরবর্তীতে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। রাত আনুমানিক ০১.৩০ ঘটিকার দিকে সে অসুস্থ বোধ করলে তাৎক্ষণিক তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ তাকে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কিছু ওষুধপত্র দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র প্রদান করলে পুনরায় তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।

শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল আনুমানিক ১০.০০ ঘটিকার দিকে মোক্তার হোসেনকে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করা হলে কোন সাড়াশব্দ না পাওয়ায় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য অতিরিক্ত কমিশনার প্রশাসন এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।পুলিশের দেওয়া এই বক্তব্যকে নিহত মোক্তার হোসেনের স্ত্রী  মুক্তা বেগম সাজানো বলে উল্লেখ করেছেন।  

সিরাজগঞ্জে ডিবি হেফাজতে সন্দেহভাজন আসামির মৃত্যু

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হেফাজতে শাহাদত হোসেন নামে এক সন্দেহভাজন আসামির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তীব্র অভিযোগ ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। নিহতের পরিবারের দাবি, ডিবি পুলিশের ওসি সিদ্দিকুর রহমান, নাজমুল হোসেনসহ কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেফতারের পর থেকেই পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছিলেন। টাকা না দেওয়ায় শাহাদতকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়, যার ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে।

শুক্রবার (২১ নভেম্বর) বিকেল ৩টার দিকে গুরুতর অবস্থায় তাকে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে আনা হলে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মারা যান।

হাসপাতালের সিনিয়র নার্স এমি খানম জানান, ডিবি পুলিশ তাকে শারীরিক নির্যাতনের আহত ব্যক্তি হিসেবে ভর্তি করেছিল। চিকিৎসা শুরু করতেই তার মৃত্যু হয়।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘শাহাদতকে সেদিন সকালেই আটক করা হয়। দুপুরের দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় মারা গেছেন, নির্যাতনের অভিযোগ সঠিক নয়।’

উল্লেখ্য, গত ১২ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় এক অটোরিকশা চালককে হত্যা করে তার অটোরিকশা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। সেই মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে দুই দিন আগে ভ্যানচালক শাহাদত হোসেনকে আটক করে ডিবি।

পরিবারের দাবি, এরপর দফায় দফায় পুলিশ টাকা দাবি করলে শাহাদাতের পরিবার তা না দিতে পারায় চালানো হয় শারিরিক নির্যাতন। শুক্রবার বিকেলে ডিবি পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ্য হলে হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যু হয় শাহাদৎ হোসেনের।

এই মামলায় সাইদুল নামের আরেক সন্দেহভাজনকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ। তার পরিবার জানিয়েছে, সাইদুলের ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, তবুও পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে এক লাখ টাকা দাবি করছে। দুপুরের পর থেকে তার অবস্থানও জানতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার।