নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সংশয়

তফসিলের প্রথম দিনেই হামলায় নির্বাচনী মাঠে আতঙ্ক

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১০:৩৭ অপরাহ্ন, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১০:৩৭ অপরাহ্ন, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রথম দিনই রক্তাক্ত হয়েছে রাজপথ। স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদী নির্বাচনী প্রচার করতে গিয়ে দিনদুপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা শহর পর্যন্ত একের পর এক হামলা, সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী ঘটনার ফলে দেশের নির্বাচনী মাঠে চরম উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খোয়া যাওয়া অস্ত্র এখনও পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে বৈধ-অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। এছাড়াও নির্বাচন বানচালে দেশি-বিদেশি চক্রান্ততো রয়েছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনী পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি বলে বার বার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতির উন্নয়ন ও নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির ঘোষণা দিলেও নির্বাচনী মাঠ এখনও মসৃণ নয়। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীদের উপর হামলা দুই দলের সংঘর্ষ সংঘাতের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন সিডিউল ঘোষণায় পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে দিন দুপুরে রাজধানী ঢাকায় স্বতন্ত্রপ্রার্থী ওসমান হাদির উপর গুলি বর্ষণের ঘটনায় পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে বলেই মনে করেন তারা। এদিকে ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। 

রাজধানীর বিজয় নগর এলাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, নির্বাচনী পরিবেশে এমন সহিংস হামলা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং দেশের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আহত ওসমান হাদীর সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া চিকিৎসা কার্যক্রম নিবিড়ভাবে তদারকি করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।

আরও পড়ুন: ভিডিও ফুটেজ দেখে হাদীর ওপর হামলাকারী দুর্বৃত্তদের গ্রেফতারে কাজ করছে পুলিশ

একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুত ও ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে হামলায় জড়িত সবাইকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ, প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য গ্রহণ, সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা এবং হামলার পেছনে কোনো সংগঠিত পরিকল্পনা থাকলে তা উন্মোচনের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা এবং প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। দোষীরা যে-ই হোক, আইনের আওতায় আনা হবে। 

তিনি দেশের সকল রাজনৈতিক পক্ষ, কর্মী-সমর্থক এবং নাগরিকদের প্রতি শান্তি ও সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানান, যাতে আসন্ন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরাপদ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

আরও পড়ুন: ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দিন। এরপরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের সহিংসতা শুরু হয়।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে গাজী তাহমিদ খান (২৫) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। গত বুধবার রাত ৮টার দিকে এ সংঘর্ষ। রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

জানা গেছে, গত বুধবার সন্ধ্যায় বারইয়ারহাট পৌর বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় ছাত্রদলের উদ্যোগে দোয়ার আয়োজন করা হয়। দোয়ার অনুষ্ঠান শেষে বারইয়ারহাট পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি দিদারুল আলম মিয়াজীর অনুসারী দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। এসময় একপক্ষের ছুরিকাঘাতে গাজী তাহসিন খান আহত হন। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বারইয়ারহাট পৌর বাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১২টার দিকে তিনি মারা যান। এছাড়াও সংঘর্ষের ঘটনায় মোহন দে, মো. আবিরসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। 

এদিকে, মাদারীপুরের ডাসারে বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর মামলায় চয়ন ইমতিয়াজ ডালিম মাতুব্বর (৩৮) নামে এক স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতাকে গ্রেফতার করেছে থানা পুলিশ।

গতকাল শুক্রবার গভীর রাতে উপজেলার পশ্চিম খিলগ্রাম এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত চয়ন ইমতিয়াজ ডালিম উপজেলার ডাসার ইউনিয়নের পশ্চিম খিলগ্রামের মৃত নূর মাতুব্বরের ছেলে এবং তিনি ডাসার উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

পুলিশ জানায়, আ.লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন দলবল নিয়ে ডাসার বিএনপির কার্যালয় ভাঙ্চুর চালায় স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা ইমতিয়াজ ডালিম। পরে ওই অফিস ভাঙ্চুরের ঘটনায় মামলা হয়। এ মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। গতকাল শুক্রবার সকালে তাকে মাদারীপুর জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।

একের পর এক এসব সন্ত্রাসী ঘটনা জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখনই এসব ঘটনার রাশ টানতে না পারলে তা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে রূপ নিতে পারে। যা নির্বাচন আয়োজনে প্রভাব ফেলবে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলি করা সন্ত্রাসীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে তিনি বলেন, ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদি দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। তার অবস্থা খুবই গুরুতর।

ওসমান হাদির ওপরে গুলিবর্ষণকারীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। সন্ত্রাসীরা যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। ডিএমপি কমিশনার বলেন, পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা, র‌্যাবসহ সবাই কাজ করছে দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারের জন্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই সহিংসতা বাড়তে পারে। সেইজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশে সুস্থ রাজনীতির ধারা দেখতে চায় সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলোকে বিদ্বেষ না ছড়িয়ে নিজের রাজনীতি করতে হবে।’ এদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হলে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ নেবে। লাভবান হবে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিয়মিতভাবে সংলাপ জরুরি, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, ‘রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকবে দলগুলোর মধ্যে। সেই সঙ্গে দেশের কল্যাণে নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার প্রয়োজন।’