কাগজে নয়, মানুষ গুগলে খোঁজে আপনার নাম

একসময় আনুষ্ঠানিক পরিচয়ের শুরুটা হতো একটি ভিজিটিং কার্ড আদান-প্রদানের মাধ্যমে। হাতে হাতে ঘুরে বেড়াতো নাম, পদবি আর যোগাযোগের ঠিকানা লেখা ছোট ছোট কার্ডগুলো। সেই কার্ডই যেন বয়ে বেড়াতো একজন মানুষের পেশাদারী পরিচিতির মূল বার্তা। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন আর সেই কার্ডগুলো সহজে মানিব্যাগে ঠাঁই পায় না, বরং এর জায়গা দখল করেছে ডিজিটাল স্ক্রিন। এখন আর মানুষ কার্ডটা গুছিয়ে রাখে না, বরং মোবাইল বের করে আপনার নাম সার্চ করে। সেখানেই শুরু হয় আসল পরিচয়ের গল্প। এই নতুন বাস্তবতায়, আপনার ডিজিটাল ব্র্যান্ড বা অনলাইন পরিচিতিই হয়ে উঠেছে আপনার সবচেয়ে শক্তিশালী ভিজিটিং কার্ড, যা আপনার জন্য খুলে দিচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত।
ভিজিটিং কার্ড থেকে ডিজিটাল ব্র্যান্ডে আপনার পরিচিতি
আরও পড়ুন: ফেসবুক রিলসে বড় পরিবর্তন আনছে মেটা
একটি ভিজিটিং কার্ডে হয়তো আপনার নাম, ফোন নম্বর বা পদবি লেখা থাকতে পারে। কিন্তু আপনার ডিজিটাল ব্র্যান্ড- মানে আপনার সুবিন্যস্ত ফেসবুক প্রোফাইল, সক্রিয় লিংকডইন উপস্থিতি, রুচিশীল ইনস্টাগ্রাম ফিড, কিংবা তথ্যসমৃদ্ধ ইউটিউব চ্যানেল- এগুলো বলে দেয় আপনি কেমন মানুষ, কী চিন্তা করেন, আপনার পেশাদারী মূল্যবোধ কোথায় এবং আপনার কর্মদক্ষতা কী।
আজকাল আমি অনেককে দেখি- চমৎকার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের অনলাইন পরিচয় একেবারে অগোছালো। কেউ হয়তো ফেসবুকে শুধু ব্যক্তিগত আড্ডার ছবি বা অপ্রাসঙ্গিক মিম শেয়ার করে, কেউ আবার পেশাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অনলাইনে একেবারেই নিষ্ক্রিয়। একটি দুর্বল ডিজিটাল ব্র্যান্ড আপনার অপার সম্ভাবনাকে আড়াল করে রাখে।
আরও পড়ুন: ইনস্টাগ্রাম স্টোরি ডাউনলোড করবেন যেভাবে
নতুন সম্ভাবনা মানেই নতুন দায়িত্ব
আপনার নাম যখন গুগলে খোঁজা হয়, তখন শুধু আপনি নন, বরং আপনার "ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট" বা ইন্টারনেটে রেখে আসা সব চিহ্নগুলোও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এটি কেবল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, এটি আমাদের নিজেদের প্রতি, আমাদের পেশার প্রতি এবং সমাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার একটি নতুন চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে, আপনি যদি নিয়মিত ছোট ছোট পোস্টের মাধ্যমে নিজের অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা এবং সৃজনশীল কাজগুলো শেয়ার করেন তাহলে ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী ডিজিটাল ব্র্যান্ড তৈরি হয়। সেই ব্র্যান্ডই একসময় আপনার হয়ে কথা বলবে , আপনার জন্য নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচন করে, এমনকি আপনাকে এমন সব প্রভাবশালী মানুষের সাথে যুক্ত করবে যাদের সাথে হয়তো আপনি কোনোদিন পরিচিত হওয়ার সুযোগই পেতেন না। আপনার এই ডিজিটাল উপস্থিতিই তখন আপনার জন্য নতুন কাজের সুযোগ, পার্টনারশিপ, এমনকি ইতিবাচক সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে দিবে।
ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড গড়তে দরকার বুদ্ধিমত্তা ও সচেতনতা
মনে রাখবেন- একটি ভিজিটিং কার্ড হয়তো কাউকে এক মুহূর্তের জন্য প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু আপনার ডিজিটাল ব্র্যান্ড তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় আপনি আসলে কে, আপনার দক্ষতা কতটা এবং আপনার চিন্তাভাবনার গভীরতা কতটুকু। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি আমাদের এই ডিজিটাল পরিচয় নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস? নাকি এটিকে অবহেলায় ফাঁকা রেখে দিচ্ছি?
আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই একটা গল্প বলি। কিছুদিন আগে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের জন্য একজন অভিজ্ঞ পেশাদার খুঁজছিলাম। পরিচিতদের মাধ্যমে কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থীর সন্ধান পেলাম। তাদের সাথে মিটিং করলাম, ভিজিটিং কার্ডও আদান-প্রদান হলো। কিন্তু মিটিং শেষে যখন একজন প্রার্থীর নাম গুগলে সার্চ করলাম, তখন হতাশ হলাম- কোনো ডিজিটাল প্রেজেন্সই নেই! এই যুগে যার কোনো অনলাইন অস্তিত্ব নেই, তার পেশাদারিত্ব নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। ফলে, আমি আর এগোইনি। শুধু ডিজিটাল ব্র্যান্ড না থাকার কারণে একটা চমৎকার সুযোগ তার হাতছাড়া হয়ে গেল!
অন্যদিকে, আরেকজন প্রার্থীর খোঁজ পেলাম। লিংকডইনে সার্চ করে দেখলাম, তিনি নিয়মিত তার কাজের অভিজ্ঞতা, নতুন আইডিয়া এবং প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ নিয়ে লিখছেন। তার প্রোফাইলটা সাজানো-গোছানো, পেশাদার ছবি, এবং তার চিন্তাভাবনাগুলো বেশ স্পষ্ট। তার ডিজিটাল উপস্থিতি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, আমি তার কাজ সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পেয়ে গেলাম, তার নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলাম। কারণ, তার অনলাইন ব্র্যান্ড তার যোগ্যতাকে আমার কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিল। বলাই বাহুল্য, সেই মানুষটিই শেষ পর্যন্ত কাজটা পেলেন।
আপনার ডিজিটাল ব্র্যান্ডকে শক্তিশালী করার কিছু সহজ টিপস:
- আপনার অনলাইন উপস্থিতি যেন আপনার সেরা সংস্করণটিকে তুলে ধরে, সেজন্য কিছু সহজ পদক্ষেপ নিতে পারেন:
- পেশাদার প্রোফাইল ছবি: আপনার লিংকডইন, ফেসবুক প্রোফাইলে একটি পেশাদার ও পরিষ্কার ছবি ব্যবহার করুন। হাসি মুখ আপনার আত্মবিশ্বাস তুলে ধরে।
- সাজানো-গোছানো বায়ো: আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বায়ো সেকশনগুলোতে (যেমন: লিংকডইন, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম) আপনি কী করেন, আপনার দক্ষতা কী এবং আপনার আগ্রহের বিষয়গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরুন। এটি আপনার পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
- সক্রিয় লিংকডইন প্রোফাইল: লিংকডইন একটি পেশাদার নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম। এখানে আপনার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং কাজের উদাহরণ নিয়মিত পোস্ট করুন। অন্যদের পোস্টে গঠনমূলক মন্তব্য করুন।
- ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের যত্ন: ব্যক্তিগত প্রোফাইল হলেও, পেশাগত দিক থেকে ক্ষতিকর হতে পারে এমন কোনো ছবি বা পোস্ট শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। আপনার শখ বা আগ্রহের বিষয়গুলো শেয়ার করতে পারেন, তবে তা যেন আপনার পেশাদারী ভাবমূর্তি নষ্ট না করে।
- নিয়মিত জ্ঞান শেয়ার: আপনার কাজের ক্ষেত্র সম্পর্কিত কোনো নতুন তথ্য, আপনার শেখা কোনো নতুন দক্ষতা বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল শেয়ার করুন। এতে মানুষ আপনাকে একজন জ্ঞানী ও চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে চিনবে।
- অন্যের সাথে যুক্ত হোন: আপনার ফিল্ডের বা আগ্রহের পেশাদারদের সাথে অনলাইনে যুক্ত হোন, তাদের কাজের প্রশংসা করুন এবং গঠনমূলক আলোচনা করুন।
- গোপনীয়তা সেটিং: আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে সামাজিক মাধ্যমের প্রাইভেসি সেটিংসগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিন।
আপনার গল্প, আপনার ব্র্যান্ড
একটি ভিজিটিং কার্ড হয়তো হারিয়ে যেতে পারে মানিব্যাগের ভেতরে, সময়ের স্রোতে মুছে যেতে পারে তার উপযোগিতা। কিন্তু আপনার ডিজিটাল ব্র্যান্ড সবসময় মানুষের চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়, নতুন সুযোগের বার্তা নিয়ে। এটি কেবল আপনার নাম বা পদবি নয়, এটি আপনার সম্পূর্ণ সত্তার একটি প্রতিচ্ছবি।
প্রশ্ন হলো- আপনি কি নিজেই আপনার ব্র্যান্ডের গল্প লিখছেন, যত্নসহকারে এটিকে গড়ে তুলছেন, নাকি অন্যরা আপনার সম্পর্কে যা দেখছে বা বলছে, সেটুকুই আপনার একমাত্র পরিচিতি হয়ে থাকছে? এই নতুন পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে, সফল হতে হলে, আপনার ডিজিটাল ব্র্যান্ডের গল্পটি আপনাকে নিজেই লিখতে হবে, এবং তা শুরু করতে হবে আজই।
শেষকথা ভিজিটিং কার্ড নয় আপনার ডিজিটাল পরিচয়ই আজ আসল পরিচয়পত্র।
লেখক: পারভেজ আহমেদ, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তা