যানজটে অস্থির বরিশাল

অবৈধ যানবাহনের পাশাপাশি বিষফোঁড়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার

Any Akter
বরিশাল সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ২:৫১ অপরাহ্ন, ১১ জুলাই ২০২৪ | আপডেট: ১০:৩৪ অপরাহ্ন, ১০ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

যানজট কিছুতেই পিছু ছাড়ছেনা বরিশালবাসীর। একদিকে অবৈধ যানবাহনের হিড়িক, অন্যদিকে সড়কের পাশে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী ওঠানামা করার জন্য থেমে থাকা যানবাহন। সবমিলিয়ে একটা জটিল পরিস্থিতি বরিশালের মহাসড়ক থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতেও। ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা লোকবল সংকট ও সিটি মেয়রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছেন বলে দায় সারছেন গত তিনবছর ধরে। 

বরিশাল পটুয়াখালী বা ঝালকাঠি মহাসড়কে রূপাতলী, সাগররদি ও নথুল্লাবাদ ছাড়াও শহরের ভিতরেই যানজটে অস্থির নগরবাসী। নতুন বাজার থেকে নথুল্লাবাদের যানজট  এখন স্থায়ী ও গাঁ সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু নগরীর বাংলাবাজার থেকে সদর রোডের জেলখানা মোড় পর্যন্ত যানজটের অন্যতম কারণ সড়কের পাশে গজিয়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলো বলে মনে করেন বরিশালের সুশীল সমাজ ও ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষ। তাদের দাবি এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোকে প্রধান সড়কের পাশ থেকে সরিয়ে সুন্দর মনোরম পরিবেশে নেয়া হলে সুচিকিৎসা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বরিশাল নগরীর যানজটও অনেকাংশে কমে যাবে। 

আরও পড়ুন: নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁয়ে ২০০ বছরের পুরোনো কাইকারটেক হাট

সরেজমিনে ১০ জুলাই বুধবার সন্ধ্যায় সড়কে নামতেই প্রথমেই আটকে যেতে হয় নগরীর বাংলাবাজার এলাকায়। এখানে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল এর জন্য বিশাল যানজট তৈরি হয়েছে সড়কে। বরগুনা থেকে আসা একটি এম্বুলেন্স থেকে রোগী নামাতে যেয়ে সৃষ্টি হয়েছে এই যানজটের। প্রায় ঘন্টা পার করে জিলা স্কুলের মোড়ে পৌঁছাতে আবারও যানজটে আটকে যেতে হয় এরিনা হোটেলের সামনে। এখানে এ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের সামনে থেকে শুরু হয়ে বিবিরপুকুর পাড় ও অশ্বিনী কুমার টাউনহল এলাকা পুরোটাই যানজটে দূর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সয়ং ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা পর্যন্ত বিরক্ত সড়কে দাঁড়িয়ে রোগী ওঠানামা করানো এ্যাম্বুলেন্স ও সিএনজিচালকদের আচরণে। সার্জেন্ট শাহিন নিজেই বিরক্তি নিয়ে বললেন, এই ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলো নগরীর বর্ধিত এলাকায় হওয়া উচিত ছিলো। 

সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাবেক সভাপতি নজমুল হোসেন আকাশ বললেন, একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা নেই। প্রধান সড়কের পাশে এগুলোর অনুমোদন হয় কি করে? তিনি আরো বলেন, বিবির পুকুর পাড়ে ডাঃ মোকলেছুর রহমান ও বেল ভিউ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল এর রোগী আসা-যাওয়ার চাপে সড়কে মহাচাপ তৈরি হয় প্রতিদিন। এমনিতেই ফুটপাত দিয়ে চলার উপায় নেই। সবটা দখল করে আছে হকার আর মোটরসাইকেল। 

আরও পড়ুন: পটুয়াখালীতে সেনা-পুলিশের যৌথ অভিযানে গাঁজা ও ইয়ার গানসহ যুবক আটক

এদিকে প্রতিদিন  সন্ধ্যার পরপরই এই চাপ দ্বিগুণ আকার ধারণ করে বলে জানান কাকলী মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল শাহিন। এসময় বেল ভিউ এর গলির সামনে দাঁড়ানো একটি সাদা মাইক্রো ও একটি এ্যাম্বুলেন্সের কারণে রাস্তার দুপাশে অসহনীয় যানজট তৈরি হয়। এই যানজট ছাড়াতে ব্যস্ত  ট্রাফিক সার্জেন্ট আতিক বলেন, এই সদর রোডে সবগুলো মার্কেট ও বিল্ডিংই এই যানজটের জন্য দায়ী। কারণ কারোই কোনো গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা নেই। ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলো আরো বেশি দায়ী বলে জানান তিনি। 

ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোতো প্রধান সড়কের পাশে থাকাই উচিত নয় দাবী করে বরিশালের সামাজিক আন্দোলনের নেতা এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, এই নগরীর কোথাও কোনো পরিকল্পনা নেই। যাচ্ছে তাই অবস্থা। ব্যাস্ততম সড়ক আটকে মিছিল মিটিং চলে, সড়কের পাশে ভবন নির্মাণ হয় কিন্তু কার পার্কিং থাকেনা। সবমিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনি দ্রুত এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলো নগরীর বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সিটি মেয়রকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান সামাজিক আন্দোলনের  নেতৃবৃন্দ। এসময় সুশীল সমাজ ও নগর চিন্তাবিদ কাজী মিজানুর রহমান, রফিকুল আলম এবং শাহ সাজেদাসহ নেতৃবৃন্দ বলেন, গত তিনমাসে নগরীতে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অটোরিকশা ও ইজিবাইক। বেশিরভাগ রিক্সা ও ইজিবাইকগুলো যাত্রীহীন ছুটে বেড়াচ্ছে। কোনটায় দু একজন যাত্রী। প্রয়োজনের তিনগুণ যানবাহনের চাপ এখানে। তারউপর এই ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের ভিড়, সদর রোড কেন্দ্রীক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এসব আইন করে বন্ধ করা উচিত বলে জানান নেতৃবৃন্দ।

সড়কে যানজট সৃষ্টির দায় এড়িয়ে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার বরিশালের ব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের জন্য সড়কে কোনো যানজট হয় না। আমাদের নিজস্ব পার্কিং রয়েছে। তাছাড়া পুলিশ কমিশনার নিজে আমাদের জন্য এখানে একটি ট্রাফিক বুথ বসিয়ে দিয়েছেন। তবে মাঝেমধ্যে সেখানে ট্রাফিক পুলিশ দেখা যায় না। লোকবল সংকটের কারণে হয়তো এটা হয়।  

আপনাদের কার পার্কিং অনেক ছোটো, এ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ উপযোগী নয় এবং মোটরসাইকেল দিয়ে ভর্তি হয়ে আছে জানালে তিনি আরো বলেন, এটা ভুল ধারনা আমাদের পার্কিং ৩ সম্পূর্ণটাই গাড়ির জন্য। ১ ও ২ মোটরসাইকেলের জন্য। তাছাড়া এখানে সড়ক ছোটো একটি বাজারও রয়েছে। যে কারণে এখানে যানজট হচ্ছে বলে জানান তিনি। 

বেলভিউ ব্যবস্থাপক জাকিরুল মোমিন বলেন, এ্যাম্বুলেন্স ও সিএনজি থেকে রোগী ওঠানামা করতে যেয়ে সদর রোডে বিশাল যানজট আমিও প্রত্যক্ষ করেছি। তবে এটা সবসময়তো হয়না, মাঝেমধ্যে হয়। উপায়ও নেই।কারণ, বেলভিউ এর কথাই ধরুন। এ গলিতে কোনো সিএনজি বা এ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে পারেনা। আবার আদি ভবন ভেঙে সড়ক বড় করাও সম্ভব না। আবার অন্যত্র সরিয়ে নিতে গেলে বেশিরভাগ ডাক্তারদের সমস্যা হবে। 

জাকিরুল মোমিন আরো বলেন, এখানে  যানজট থাকবেই, কিছুটা কমানো সম্ভব যদি ইজিবাইক, অটোরিকশা ও সিএনজিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের বেশিরভাগ অংশই এই ব্যবসায় জড়িত অথবা এদের থেকে সুবিধাভোগী দাবী করে বরিশালের ট্রাফিক বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) তানভীর আরাফাত বলেন, আমরা বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার যানজট নিরসনের জন্য সিটি মেয়রের কাছে লিখিত কিছু প্রস্তাবনা আগেই দিয়েছি। য়ার মধ্যে অন্যতম এই ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল এবং মার্কেট। এগুলো হয় নিজদের কার পার্কিং ব্যবস্থা করবে, নয়তো শহরের বাইরে চলে যাবে। একইসাথে নগরীতে কতগুলো যানবাহন চলবে, ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলবে কিনা এসব বিষয় ঠিক করতে হবে সিটি মেয়রকে। তিনি না বললে আমরা নিরূপায়। 

৫৮ বর্গকিলোমিটারের বরিশাল নগরীতে মাত্র পাঁচ হাজার যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা থাকলেও বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে চলছে অন্তত ৫০ হাজার যানবাহন। এরমধ্যে প্রায় সাত হাজারের মতো সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বৈধতা থাকলেও অবৈধভাবে চলছে এরচেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি থ্রী হুইলার। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে অবৈধ যানবাহন তৈরির গ্যারেজ। আর এসব গাড়ি সড়কে নেমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়সহ যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানোর কারণে তীব্র যানজট দেখা দিচ্ছে। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। 

নগরবাসীর দাবি, যানজট থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পেতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি অবৈধ গাড়ি তৈরির কারখানা বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, পরিকল্পিত বরিশাল গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক করার পাশাপাশি সড়কের যানবাহন চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এ জন্য আরেকটু সময় প্রয়োজন। 

মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, আমি হুটহাট অপরিকল্পিত কাজ করতে পছন্দ করিনা। যা করবো নগরবাসী তা মনে রাখবেন এটা আমার বিশ্বাস। নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ, তারা যেন একটু ধৈর্য ধরেন এবং আমার উপর আস্থা রাখেন। ইতিমধ্যেই সড়ক ও সিটির চারপাশে কোথায় কি প্রয়োজন তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা এসে দেখেছেন এবং তারা যাচাই-বাছাই করেছেন। তাদের এবং বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ নগর চিন্তাবিদদের সহযোগিতা নিয়ে সবদিক বিবেচনা করে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান সিটি মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত ।