গৌরব-ঐতিহ্যের ৭২ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

পদ্মাতীরের এক কুঠিবাড়ি থেকে আজকের দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ৭২ বছর। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ যাত্রাপথে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে আজও দেশ ও জাতির প্রগতি ও জ্ঞানের বাতিঘর হয়ে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
উত্তরাঞ্চলের শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র অঞ্চলের নয়, দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে শিক্ষার এক অমূল্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের আত্মপ্রকাশ ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ ছিল, যা আজ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের এক অধ্যায়।
আরও পড়ুন: সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে পঞ্চগড়ে সাংবাদিকদের মানববন্ধন
১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই অধ্যাপক ইতরাত হোসেন জুবেরীকে প্রথম উপাচার্য করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এর আগে ১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্টজনদের নিয়ে গঠিত ৬৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্রসমাবেশ এবং ভুবন মোহন পার্কে জনসভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জোরদার হয়। আন্দোলনের সময় ১৫ জন ছাত্রনেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়, যা জনআন্দোলনের তীব্রতা বাড়ায়। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন পাশ হয়।
আরও পড়ুন: চানপুরে অভিযান চালিয়ে ২ মাদক কারবারি কে ইয়াবা সহ গ্রেফতার করেছে যৌথবাহিনী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষার কেন্দ্র নয়; এটি ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় গণআন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার, হবিবুর রহমান, মীর আবদুল কাইয়ুম, ইতরাত হোসেন জুবেরী ও মজিবর রহমান দেবদাসসহ অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার ত্যাগ ও রক্তের ঐতিহ্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের অংশ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীকে রয়েছে একটি বৃত্ত যা বিশ্বের প্রতীক। একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ যা জ্ঞানের প্রতীক এবং আকাশদৃষ্টি থেকে শাপলা ফুল সৌন্দর্য, যা পবিত্রতা ও জাতীয় প্রতীক। এই প্রতীকের নকশা করেন শিল্পী গোলাম সারওয়ার, আর পরবর্তীতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী হাশেম খান এর নান্দনিক রূপায়ন করেন। প্রতীকের বৃত্ত ও মূল গ্রন্থে রঙ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কোবাল্ট ব্লু যা আকাশ, নদী ও উদারতার রং। গ্রন্থের বহিঃরেখায় রক্তলাল, যা জাতীয় পতাকার রং। পরিশেষে গ্রন্থের মধ্যরেখায় ব্যাবহার করা হয়েছে সোনালি রঙ, যা সোনার মতই মূল্যবান শিক্ষার গুণগত মূল্যকে বোঝাতে ব্যাবহৃত।
৩০৪ হেক্টর (প্রায় ৭৫৩ একর) আয়তনের ক্যাম্পাসে ১২টি অনুষদ, ৫৯টি বিভাগ ও ৬টি গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষালাভ করছে, যার মধ্যে রয়েছে ৩১ জন বিদেশি শিক্ষার্থী। এখানে কর্মরত শিক্ষক সংখ্যা ১,০১২ জন, গবেষক পর্যায়ে রয়েছে ৪৪৪ জন এমফিল ও ১৯৯ জন পিএইচডি গবেষক।
শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ১৪টি অ্যাকাডেমিক ভবন, ১৭টি আবাসিক হল (ছাত্রদের জন্য ১১টি, ছাত্রীদের জন্য ৬টি) ও ১টি আন্তর্জাতিক ডরমিটরি। সুবিধাসমূহের মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, আইসিটি সেন্টার, স্টেডিয়াম, সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, সাংস্কৃতিক মিলনায়তন ও অন্যান্য আধুনিক অবকাঠামো।
সবশেষ যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল নেচার ইনডেক্স র্যাংকিং মার্চ ২০২৫ অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মধ্যে গবেষণায় শীর্ষস্থান দখল করেছে। এর আগে স্কোপাসের জরিপে দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে গবেষণায় সবার শীর্ষে অবস্থান করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইউএস গ্লোবাল নিউজ র্যাংকিং ২০২৫ অনুযায়ী বিশ্বের গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এর অবস্থান ৬৩৮তম।
এর আগে এ বছরের ২৭ জানুয়ারি প্রকাশিত ওয়েবমেট্রিক্স র্যাংকিংয়ে দেশের শীর্ষস্থান অর্জন করেছে রাবি। তাছাড়া বিশ্বসেরা ২ শতাংশ বিজ্ঞান গবেষকের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবসহ ১৫ জন গবেষক স্থান পেয়েছেন। গবেষণার গুণমান ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির এক উজ্জ্বলতম অবস্থানে পৌঁছেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গৌরবজনক অবস্থান গড়ে তুলেছে। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিন পুনরুদ্ধারে সাফল্য ও পানিকে আর্সেনিক দূষণমুক্ত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ‘গ্রিন চিলি পাউডার’ ও সজনে পাতার গুঁড়া তৈরি, ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএইচএম খুরশীদ আলমের চার সবজি থেকে ক্যান্সার প্রতিরোধী গুণ ও তুঁত গবেষণায় ক্যান্সার ও হৃদরোগ প্রতিরোধী আবিষ্কার, ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসেনের উন্নত প্রজাতির মাছ গবেষণা এবং বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছের ৮ প্রজাতির হাওড়ে ফিরিয়ে আনার অবদান অন্যতম।
এছাড়া, বিরল অর্কিড কাঞ্চন, ফুলের জীবন্ত চিত্রকর্ম, মাটি ছাড়া ঘাস ও আনারস চাষে টিস্যু কালচার প্রযুক্তি উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন এগ্রোনমি বিভাগের অধ্যাপক ড. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু রেজার দেশের প্রথম সাপের বিষের ডেটাবেইস তৈরি, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহরিয়ার শোভনের গেছো শামুকের ক্যাপটিভ প্রজননে সাফল্য এবং একই বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ হোসেনের হাত ধরে আর্সেনিক দূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে গবেষণা।
এদিকে লবণ ছাড়া চামড়া সংরক্ষণের টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দেশের প্রথম সফল গবেষণা করেছেন ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম। প্লাজমা টেকনোলজি ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছেন ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার। এসব গবেষণা দেশের বাস্তব ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব রাখছে।
এই বছর ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৬২ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, লাইভস্টক, খাদ্য ও আনসারসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন রাবির মেধাবী শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে, গত চার বছর টানা ১ম স্থান অর্জনসহ বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষাতেও বরাবরের মতো সফল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এবছরের ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষাতেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে মোট ২৮ জন শিক্ষার্থী সহকারী জজ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু আইন বিভাগের ৪০তম ব্যাচ থেকেই নির্বাচিত হয়েছেন ১২ জন, যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনি শিক্ষায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক মো. আখতার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিকভাবে সন্তোষজনক অবস্থানে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান তৈরি করেছে। তবে আমাদের দায়িত্ব হলো বাজারচাহিদাভিত্তিক গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা। এজন্য কারিকুলাম আধুনিকায়নের চেষ্টা চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু কারিকুলাম যথেষ্ট নয়—শিক্ষার্থীদেরও আত্মপ্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিজেএস বা বিসিএসে যারা সফল, তারা নিজ উদ্যোগেই এগিয়ে এসেছে। অথচ অনেকেই যোগ্যতা থাকার পরও প্রেরণা ও তাগিদের অভাবে পিছিয়ে পড়ে। তাই এমপ্লোয়াবিলিটির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতায় পৌঁছাতে পারলে রাবি শিক্ষার্থীরা সবক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘দেশের দ্বিতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের সঙ্গে ৭২ বছরে পদার্পণ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব স্টেকহোল্ডারকে শুভেচ্ছা জানাই।’
তিনি আরও জানান, ‘সার্বিকভাবে একাডেমিক সংস্কার ও মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি বিভাগে কারিকুলাম আধুনিকায়নের কাজ চলছে। একাডেমিক শৃঙ্খলা ও ক্লাস পরিচালনায় ক্রেডিট ফলো হচ্ছে কি না, তা তদারকি করা হচ্ছে। শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে টিচার ইভালুয়েশন চালু হবে। পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে নাম-রোলবিহীন কোডিং-ডিকোডিং ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে।’
পরিশেষে, প্রতিবারের মতো এইবারো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করা হচ্ছে নানা আয়োজনে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন সকাল থেকে রয়েছে র্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৃক্ষরোপণ ও আলোকসজ্জাসহ নানা আয়োজন। পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ।