গাছ কেটে উজাড় করছে খোলপেটুয়ার চর বনায়ন, হুমকিতে উপকূল

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার খোলপেটুয়া নদীর তীরে প্রায় ৩০০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা চর বনায়নের গাছ কেটে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। দিনের পর দিন নির্বিচারে এসব গাছ কেটে নেওয়া হলেও এ বিষয়ে প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ করেছেন উপকূলীয় এলাকাবাসী।
উপজেলার দীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুর ও গাবুরার সংযোগস্থল চৌদ্দরশি ব্রিজের পশ্চিমে গড়ে ওঠা চরের বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি উপজেলার উপকূলীয় চর বনায়নেও মাঝেমধ্যে এমন গাছ কাটার ঘটনা শোনা যায়।
আরও পড়ুন: চুয়াডাঙ্গায় মদপানে ৬ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে আরও ১
খোলপেটুয়া নদীতে প্রায় ৭০০ বিঘা জায়গাজুড়ে একটি বড় চর জেগে ওঠে। সেখানে প্রথমে স্থানীয়ভাবে বনায়ন শুরু করলেও পরবর্তীতে এটি সুন্দরবনসংলগ্ন হওয়ায় নদীর জোয়ারে ভেসে আসা নানা গাছের ফল চরে আটকে গাছগুলো জন্ম নেয়। এতে নদীর প্রায় ৭০০ বিঘা জায়গাজুড়ে বেড়িবাঁধ ঘেঁষে চরে গড়ে ওঠে সবুজ ঘন বন। তবে গড়ে ওঠা সেই সবুজ বন আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
স্থানীয়রা জানান, দিন-রাত সমানতালে করাত, কুড়াল দিয়ে নিঃশব্দে গাছ কাটছে উপকূলীয় দুই ইউনিয়ন গাবুরা ও পদ্মপুকুরের সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে উৎপাদনশীল করতে হলে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে: ড. মঈন খান
খোলপেটুয়া নদীর চরে এ বনায়ন অঞ্চলে যত্রতত্র গর্ত খুঁড়ে মাছ শিকারের জন্য ফাঁদ তৈরি করা হচ্ছে। শিকারিরা তাদের মাছ ধরার সুবিধার্থে চর বনায়নের এসব গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলছেন। মাছ ধরার গর্তে পানি আটকে থাকার কারণে সেখানে নতুন গাছ জন্মাতে পারছে না। যেকারণে দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে এই চর বনায়ন।
স্থানীয়রা আরো বলেন, এ বিষয়ে বারবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসনকে অবগত করা হলেও তারা দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ফলে নদীর চরের গাছ কাটা অব্যাহত থাকায় নদীর চরের বন নীরবে উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাটা গাছের ডালপালা ফেলে রাখা হয়েছে বনের ভেতরে। বনের ভেতরে ছোট-বড় নানা প্রজাতির গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া এ চরবনে অসংখ্য গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে যা জোয়ারের সময় পানিতে ভরে যায়। স্থানীয়দের দাবি, এসব গর্তে জোয়ারে রেণুপোনা এসে আটকা পড়ে যা পরে ভাটির সময় ধরে বাজারে বিক্রি করা হয়। এছাড়াও এই বনের গাছ নিধনে মূলত গাবুরা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের খোলপেটুয়া, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ গাজীপাড়া এবং ওই চরে গড়ে ওঠা বনের কাছাকাছি বসবাসরত পরিবারগুলো জড়িত। তারা একে অপরের যোগসাজশে এ অপকর্ম করছে।
স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, স্থানীয় কয়েকটি চক্র প্রথমে ওই চরে যেখানে-সেখানে ইচ্ছামতো গর্ত খুঁড়ে মাছ শিকারের সুবিধার্থে ফাঁদ তৈরির জন্য বনায়নের ওই গাছ কাটা শুরু করেন। এরপরে পার্শ্ববর্তী গাবুরা ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকার কিছু মানুষও এই ধ্বংসযজ্ঞে যোগ দেন। এভাবে গত কয়েক মাসের মধ্যে কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, যা আজও চলমান।
স্থানীয় পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালী গ্রামের খোকন সরদার বলেন, আগে এই চরে প্রচুর গাছ ছিল। এখন চর প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়েছে। গাছ কাটার শব্দ যাতে লোকালয়ের সাধারণ মানুষের কানে না আসে, সেজন্য করাত দিয়ে গাছ কাটে তারা। আবার অনেক সময় দেখা যায় তারা গাছ কেটে রেখে যায়, এরপর দুই-এক দিন পার হয়ে গেলে সেই গাছ নিয়ে যায়— যাতে মানুষকে বোঝানো যায় গাছটা মারা গিয়েছে, আর সে মরা গাছ কেটে নেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় অধিকাংশ মানুষের অভিযোগ, খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ঘেঁষে প্রায় ৭০০ বিঘা জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা বনটি ধ্বংসের পথে। নদীপাড়ের সাধারণ মানুষ জ্বালানি কাঠ, ঘর তৈরির কাঠ আর আসবাবপত্রের জন্য পুরোপুরি এই বনের ওপর নির্ভর করে। এছাড়াও মাছ শিকারিদের দৌরাত্ম্যে নতুন গাছ জন্মাচ্ছে না ওই বনে। তারা দিনের বেলায় এসে গাছ কেটে রেখে যায়, আর জোয়ারের সময় নৌকায় করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী গাবুরা ইউনিয়ন থেকেও নৌকা করে এসে অনেকে কেউড়া ফল সংগ্রহের নামে বড় বড় গাছ কেটে নিয়ে যায়। নিষেধ করলে শোনে না। আগে বন রক্ষায় একটা কমিটি ছিল, এখন আর নেই। সেই সুযোগে চলছে নির্বিচারে গাছ কাটা।
এ বিষয়ে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ৮৩নং পশ্চিম পাতাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস. এম. রুহুল কুদ্দুস অভিযোগ করে বলেন, গাবুরার খোলপেটুয়া নদীর তীরবর্তী গ্রামের কিছু লোক এবং পদ্মপুকুরের ৮নং ওয়ার্ড পূর্ব পাতাখালী গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার ২৫ থেকে ৩০ জন বাসিন্দা এবং ওই বন সংলগ্ন ওয়াপদার ওপর বসবাসরত লোকজন সরাসরি এ বন নিধনের কাজে জড়িত। এছাড়াও স্থানীয় কয়েকজন চিহ্নিত মাদকসেবীও তাদের মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে এ বনের গাছ চুরি করে কেটে বিক্রি করে। আবার বাগদা ও হরিণা চিংড়ির রেণু ধরার জন্য নির্ধারিত কিছু ব্যক্তি এ বনের মধ্যে গাছ কেটে শতাধিক গর্ত তৈরি করে রেখেছে। এর ফলে একদিকে ক্রমাগত পুরাতন গাছ নিধন হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন চারাগাছ জন্মাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
ইতোপূর্বে যারা এ বন দেখভালের নামকাওয়াস্তে দায়িত্ব পালন করছিল তারাও ব্যক্তিস্বার্থে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এ চর বনায়ন উজাড়ের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানান তিনি। এছাড়াও তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে এবং কিছুটা এনজিওর সহযোগিতায় গড়ে ওঠা এ বন রক্ষার্থে চেয়ারম্যান, মেম্বার, স্থানীয় লোকজন ও এনজিওর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে নখ-দাঁতহীন সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির কর্মকর্তাদের গর্জনও। এখন দরকার প্রশাসনিক ও পুলিশি ব্যবস্থা। অন্যথায় গাছ নিধন হলে জেগে ওঠা চর বিলীন হবে, হবে নদী ও ওয়াপদা ভাঙন। ঠেকানো যাবে না জলোচ্ছ্বাস এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী পরিচালক সোহানুর রহমান বলেন, বনের ভেতরে গর্ত করে মাছের পোনা ধরা আর নির্বিচারে গাছ কাটা পরিবেশের জন্য ভয়ংকর হুমকি। এতে নতুন করে গাছ জন্মায় না, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়। অথচ এসব সামাজিক বন উপকূল রক্ষার প্রাকৃতিক বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে। বন ধ্বংস হলে পরিবেশের ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।
বছরের পর বছর ধরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ছোট-বড় দুর্যোগেীয় এলাকাকে প্রাচীর হিসেবে রক্ষা করছে চর বনায়নের এসব গাছ। আর এভাবে গাছ কাটা চলতে থাকলে চর বনটি আর টিকবে না। তখন দুর্গম এই উপকূলীয় এলাকায় বিপদগ্রস্ত হবে হাজার হাজার সাধারণ পরিবার।
স্থানীয় পদ্মপুকুর ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলাম বলেন, খোলপেটুয়া নদীর চরে গড়ে ওঠা বনায়নের গাছ কেটে নেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিছু দুর্বৃত্ত চুরি করে এসব গাছ কাটছে এবং পাচার করছে। আমরা এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ধরার চেষ্টা করছি।
এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাঃ রনি খাতুন জানান, বেআইনিভাবে এসব চর বনায়নের গাছ কাটার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এখনই স্থানীয় দুই চেয়ারম্যান ও সামাজিক বন বিভাগকে জানাচ্ছি। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।