বিবিসির প্রতিবেদনে

সেন্ট মার্টিন খুলছে,কিন্তু পর্যটক যাওয়া নিয়ে সংশয়

Any Akter
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ৭:৫৯ পূর্বাহ্ন, ০১ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৭:৫৯ পূর্বাহ্ন, ০১ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

টানা নয় মাস বন্ধ থাকার পর অবশেষে সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে আগামীকাল পহেলা নভেম্বর। কিন্তু পর্যটকদের এখনই সেখানে যাওয়া হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

এর কারণ হিসেবে সরকারি বিধিনিষেধকে দুষছেন পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা। শেষ মুহূর্তে পর্যটকবাহী জাহাজ চালানোর সিদ্ধান্ত থেকেও সরে এসেছেন জাহাজ মালিকরা।

আরও পড়ুন: সিলেটে সিপিবি নেতা আটক

মূলত সরকারি নির্দেশনায় নভেম্বর মাসে দ্বীপটিতে রাতে থাকার সুযোগ না রাখাসহ বাড়তি কড়াকড়ি আরোপের কারণেই এই জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা।

জাহাজ মালিকরা বলছেন, সেন্ট মার্টিন চালুর খবরে শুরুর দিকে পর্যটকদের কাছ থেকে বেশ সাড়া পেলেও বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর আগ্রহ কমে গেছে।

আরও পড়ুন: বগুড়ায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আবার ফিরবে: তামিম ইকবাল

এছাড়া টেকনাফের পরিবর্তে কক্সবাজার থেকে জাহাজ ছাড়ার সিদ্ধান্তের কারণে দুরত্ব বেড়ে যাওয়ায় জাহাজের পরিচালনা খরচও অতীতের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে বলেও দাবি তাদের।

দীর্ঘদিন পর পর্যটকদের জন্য দ্বীপটি খুলে দেওয়া হলেও সরকারের বিধিনিষেধের কারণে খুব একটা লাভ হবেনা বলেই মনে করেন বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ রাফিউজ্জামান।

তিনি বলছেন, "নভেম্বরে থাকা যাবে না, তাহলে পর্যটক কেন যাবে? ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নির্বাচনের কারণে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কেমন থাকবে, তা অনিশ্চিত, তখনও পর্যটক যাবে কিনা সন্দেহ। অর্থাৎ সেন্টমার্টিন চালু হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্টদের তাতে তেমন সন্তুষ্টির কিছু দেখি না"।

এদিকে, সেন্টমার্টিন দ্বীপে যেতে সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে, তার বাইরে কোনো পর্যটককে দ্বীপটিতে প্রবেশ করতে না দেওয়ার কথা জানিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক এম এ মান্নান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "সেন্টমার্টিন যাওয়ার বিষয়ে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেটি সরকারিভাবেই নির্ধারিত। এর মধ্যে থেকেই তাদেরকে জাহাজ পরিচালনা করতে হবে।"

শেষ মুহূর্তে কেন অনিশ্চয়তা

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনে গত পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, দ্বীপটির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

গত ২৫শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসের এক অনুষ্ঠান থেকে দ্বীপটি পর্যটকদের জন্য পহেলা নভেম্বর থেকে আবারো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান বেসামরিক বিমান ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

জানানো হয়, পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হলেও দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।

পর্যটকদের মধ্যে ব্যপক সাড়া ফেলে সেন্ট মার্টিন খোলার এই ঘোষণা। কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই বলছেন, সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার সুযোগ মিলছে, এই খবর আসার পর থেকেই অনেক পর্যটক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।

স্থানীয় ট্যুর অপারেটর আইয়ুব আলী খান বিবিসি বাংলাকে জানান, "সেন্ট মার্টিন নভেম্বরে খুলবে, এই ঘোষণা আসার পরই অনেকে আমাদেরকে ফোন দিয়েছে অগ্রিম বুকিংয়ের জন্য। জানতে চেয়েছেন কবে যেতে পারবেন, থাকার অবস্থা কী- এমন নানা খবর নিছেন তারা।"

তবে সম্প্রতি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দ্বীপটিতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কি কি বিধিনিষেধ বা নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে, সে বিষয়ে ১২ দফা নির্দেশনা জারি করে সরকার। যেখানে জানানো হয়, নভেম্বরের দ্বীপটিতে যেতে পারলেও সেখানে রাতে থাকতে পারবেন না পর্যটকরা।

সরকারের এমন বিধিনিষেধের কারণে পর্যটকদের আগ্রহ কমেছে বলে বলছেন ট্যুর অপারেটররা।

আর এমন প্রেক্ষাপটে পহেলা নভেম্বর কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়ার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে 'কর্ণফুলী এক্সপ্রেস' ও 'বার আউলিয়া' নামে দুটি পর্যটকবাহী জাহাজের যাত্রা করার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে জাহাজ মালিকপক্ষও এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন

সেন্ট মার্টিন রুটে ফ্রেন্ডস ট্রেডিং কর্পোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অন্তত তিনটি জাহাজ চলাচল করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল সাঈদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, সেন্টমার্টিন খোলার খবরে পর্যটকদের যে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, রাত্রিযাপন করতে পারবেনা, এই খবরে সেই আগ্রহ আর নেই।

তিনি বলছেন, "অল্প সংখ্যক যাত্রী নিয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়া-আসা করে আমাদের খরচ উঠবে না, লাভ তো দূরে থাক। এ কারণেই আমরা নভেম্বরে জাহাজ চালাতে পারবো না।"

এছাড়া টেকনাফ সীমান্তে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির উপস্থিতি ও মাঝেমধ্যেই জেলে অপহরণের ঘটনাও সেন্ট মার্টিন যাতায়াতের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করেছে।

অতীতে সেন্ট মার্টিনের পর্যটকবাহী জাহাজ টেকনাফ থেকে ছাড়লেও এখন নিরাপত্তার কারণে কক্সবাজার থেকে যাত্রা শুরু করবে।

জাহাজ মালিকরা বলছেন, নুনিয়ারছড়া থেকে সেন্ট মার্টিন যেতে প্রায় দ্বিগুণ পথ পাড়ি দিতে হবে, যাতে জাহাজ পরিচালনা ব্যয় বাড়বে। এছাড়া এতো সময় যাত্রা করে দ্বীপটিতে গিয়ে কিছু সময়ের ব্যবধানেই আবার ফিরতে হবে পর্যটকদের।

"মানুষ ঘুরতে যাবে, দেখতে যাবে। যদি সেখানে গিয়ে কিছুটা সময় থাকতেই না পারে তাহলে কেন যাবে সেখানে," বলেন মি. সাঈদ। যদিও বুকিং ভালো থাকায় ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে জাহাজ চলবে বলে জানান তিনি।

তবে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক এম এ মান্নান দাবি করেন, পহেলা নভেম্বর থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচলের জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "পর্যটকদের জন্য অ্যাপস চালু করা হয়েছে। সেন্টমার্টিনের ক্ষতিগ্রস্ত জেটিও মেরামত করা হয়েছে। প্রশাসন সব প্রস্তুতি রেখেছে যাতে পর্যটক সেখানে যেতে পারে। তবে জাহাজ মালিকরা হঠাৎই জাহাজ না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলছি।"

সরকারের দেওয়া শর্ত মেনেই সেন্টমার্টিন যেতে হবে। এক্ষেত্রে কেউ অবৈধ পথে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান জেলা প্রশাসক।

মানতে হবে ১২ নির্দেশনা

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১২ দফা নির্দেশনা জারি করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। যেখানে দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআইডব্লিউটিএ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কোনো নৌযান চলাচল করা যাবে না।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস এবং কিউআর কোড যুক্ত থাকবে। কিউ আর কোড বিহীন টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

নভেম্বর মাসে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে রাতে থাকতে পারবের না পর্যটকরা অর্থাৎ দিনে গিয়ে দিনেই ফিরতে হবে। তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে সেখানে রাতেও থাকা যাবে। আর ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে দ্বীপটির দুয়ার।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক যেতে পারবে সেন্ট মার্টিনে। ভ্রমণের সময় রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ পার্টিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এছাড়া কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়-বিক্রয়, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা যাবে না। একই সঙ্গে সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যেকোনো মোটরচালিত যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

এছাড়া সেন্ট মার্টিন ভ্রমণকালে নিষিদ্ধ পলিথিন এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক, যেমন- চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের চামচ, শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, বহন করতে পারবেন না পর্যটকরা।

৫০০ ও ১০০০ মিলিলিটারের প্লাস্টিক বোতল বহনের ক্ষেত্রেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এর বদলে পর্যটকদেরকে নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক বহন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।