বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন জনপদ উয়ারী-বটেশ্বর

Sadek Ali
আশিকুর রহমান, নরসিংদী
প্রকাশিত: ৪:০০ অপরাহ্ন, ০৭ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৮:১৮ অপরাহ্ন, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

রাজধানীর ঢাকা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়নে পুরাতন ব্রহ্মুত্র ও আড়িয়ালখাঁ নদীর মিলনস্থলের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে প্রাচীন জনপদ উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থান। দু’পাশে ফসল আর ফসলবিহীন ক্ষেতের প্রাসত্মর টিলাময় লাল মাটির এক অঞ্চল। ব্রিটিশ আমলে নরসিংদী ছিল নারায়নগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত এলাকা। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭-এ নরসিংদী মাহকুমায় উন্নীত হয়। বর্তমানে নরসিংদী সদর, পলাশ, শিবপুর, মনোহদরী, বেলাব ও রায়পুরা এই ৬টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়নের উয়ারী,-বটেশ্বর গ্রাম সেই প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক  জায়গা। আর এই উয়ারী বটেশ্বর এ রয়েছে আদি ইতিহাস। বিশেষজ্ঞদের মতে এটি বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন জনপদ। এ অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে তাম্র প্রসার যুগ, আদি-ঐতিহাসিক যুগ, প্রাক-মধ্যযুগ ও মধ্যযুগে নরসিংদী জেলার উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে যে মানব-সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল তার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই অঞ্চল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ফসিল-উড ও পাথরের তৈরি প্রগৈতিহাসিক যুগের হাতিয়ার ও তাম্র-প্রসার যুগের গর্ত বসতির চিহ্ন আবিষ্কার করেছেন। এছাড়া এ অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন ৬০০মিঃ× ৬০০ মিঃ আয়তনের চারটি দূর্গ প্রাচীর। যে দূর্গ প্রাচীরের চারিদিকে রয়েছে পরিখা যা চোখের দৃষ্টিতে সহজেই অনুধাবন করা যায়। উয়ারী দূর্গের পশ্চিম দক্ষিণে প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২০ মিটার প্রসস্ত ১০ মিটার উঁচু অসম রাজার গড় নামে একটি মাটির বাঁধ রয়েছে। তাছাড়া প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এখানে গলিপথ সহ ১৬০মিটার দীর্ঘ রাস্তাও আবিষ্কৃত হয়েছে।

উয়ারী বটেশ্বরে খনন কাজ মূলত ২০০০ সালের এপ্রিল মাসেই প্রথমবারের মতো খনন কাজ করা হয়। তখন থেকেই নগর বৈশিষ্ট্যের ধারণাটি নিশ্চিত হতে থাকে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ দাবী করেছেন উয়ারী-বটেশ্বর ছিল প্রাচীন গঙ্গারিডি রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত। উয়ারীতে আবিস্কৃত দ্বিতীয় অনুপম ইট নির্মিত স্থাপত্যটি জনগণকে বিস্মিত করেছে। বিপুল সংখ্যক ধাতব, স্বল্প-মূল্যবান পাথর এবং কাঁচের পূঁতির অলংকার একটি নগর সভ্যতার সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে। ২০০৮-০৯ সালের অষ্টম বারের খনন কাজে কামরাবো এলাকায় ধুপির টেকের মন্দির ভিটার আবিষ্কৃত বৌদ্ধ পদ্ম মন্দিরটি মধুপুরগড়ের পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের উপত্যকায় আদি মধ্যযুগে বৌদ্ধসভ্যতা বিস্তার সাক্ষীবাহী।

আরও পড়ুন: অপহরণের দুইদিন পর ইসমাইল মোল্লাকে বাগেরহাট থেকে উদ্ধার

সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত হয়েছে পেরেক, লৌহমল, লৌহ গলানোর ফলে অতি ক্ষুদ্র বল, মরিচাপড়া লৌহবস্ত্ত প্রভৃতি। প্রাপ্ত পোড়ামাটি থেকে ধারনা করা যায় যে, এ স্থানে উচ্চ তাপমাত্রায় লোহা গলানোর প্রযুক্তির প্রচলন ও ব্যবহার ছিল। ওয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নস্থানের ধর্মীয় প্রকৃতি জানা যায় না। তবে প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত নবড্ মৃৎপাত্র এতদঞ্চলে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ইঙ্গিত বহন করে। দিলীপ কুমার চক্রবর্তী (অধ্যাপক, সাউথ এশিয়ান আর্কিওলোজি, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি) মনে করেন যে, উয়ারী-বটেশ্বরের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। কারণ প্রাপ্ত রুলেটেড মৃৎপাত্র, স্যান্ডউইচ কাঁচের পুঁতি, স্বর্ণ আবৃত কাঁচের পুঁতি, টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জ ইত্যাদি সব উপকরণ এ তথ্যের সত্যতার প্রমাণ দেয়। গর্ডন চাইল্ডের মতে, উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলটি টলেমি (দ্বিতীয় শতকের ভূগোলবিদ) উল্লেখিত ‘সোনাগড়া’। কারণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একক রঙের কাঁচের পুঁতি উয়ারী-বটেশ্বর ছাড়াও শ্রীলংকার মানটাই, দক্ষিণ ভারতের আরিকামেদু, থাইল্যান্ডের কিয়ন থম প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিল। সম্প্রতি উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে ইটের স্থাপনা পাওয়া গিয়েছে যা গর্ডন চাইল্ডের নগরায়ণ এর বৈশিষ্ট্যকে সমর্থন করে। বিশেষজ্ঞরা একমত যে, উয়ারী বটেশ্বরে কেবল নগরায়নই ঘটেনি, ব্রহ্মপুত্র নদের উপস্থিতির কারণে এ অঞ্চল একই সঙ্গে ছিল নদীবন্দর এবং বাণিজ্য নগর।

প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন হিসেবে রয়েছে যথাক্রমে: ছাপাংকিত রৌপ্য মুদ্রা, ১৫-১৬ শতক আগের ব্রোঞ্জ মূর্তি, ১-২ শতক আগের প্রাচীন মৃৎপাত্র,  ১৯ শতক আগের ব্রোঞ্জের লৌহ-কুঠার ও কাঠ ইত্যাদি, ১৭ শতকের মনসা মঙ্গল কাব্য, ১৯ শতকের হসত্ম লিখিত সবচেয়ে ক্ষুদ্র কোরআন শরীফ, মিশরের প্যাপিরাস (সংযুক্ত প্যাপিরাস শিল্পকর্মটি প্রাচীন মিশরীয়গন যে পদ্ধতিতে প্যাপিরাস তৈরি করতো সেই পদ্ধতিতে তৈরি)। নেদারল্যান্ডে কার্ব-১৪ টেষ্টে তারিখ নির্ধারণের মাধ্যমে উয়ারী-বটেশ্বর গ্রাম দুটি দেশের সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীনস্থান। এতে যে সকল নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে সেগুলো ২৪৫০ বছর  আগের অর্থাৎ খ্রিস্ট জন্মের ৪৫০ বছর আগের বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তখন ছিল মৌর্যবংশের রাজত্বকাল। এরপর ২০০২ সালের জুন মাসে দ্বিতীয়বারের মতো  খনন কাজ করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ছাড়াই এ অঞ্চল থেকে ভূ-পৃষ্ট সংগ্রহ হিসেবে উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চল থেকে এক হাজার লৌহ নিদর্শন, কয়েক হাজার ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা এবং প্রচুর সংখ্য স্বল্পমূল্যবান প্রসত্মরের পূজি সংগৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যকোন অঞ্চল থেকে এত লৌহ নির্দশন, ছাপাংকিত রৌপ্য ও প্রসত্মরের মূর্তি সংগ্রহ করা যায়নি। এছাড়াও পাওয়া গেছে নব্যপ্রসত্মর যুগের বৈশিষ্টযুক্ত প্রসত্মর ও অশ্মীভূত কাঠের হাতিয়ার, নকশাঙ্কিত রক্ষাকবচ, হাই-টিন ব্রোঞ্জ নির্মিত নবযুক্ত পাত্র, কাচের পুতি, বস্ন্যাক সিস্নপড ওয়্যার এবং পোড়ামাটি ও পাথরের বিবিধ নিদর্শন। মধ্যযুগের প্রথম দিকে দীর্ঘ আকার বিশিষ্ট অসম রাজার গড় নামে একটি দূর্গ পাওয়া গেছে।ফলে একটি সুরক্ষিত নগরকেন্দ্র, পাকা রাস্তা এবং শহরতলির বসতি উন্মোচিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: গুলিবিদ্ধ বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহকে ঢাকায় স্থানান্তর