পূবালী ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি লুটপাট

Sanchoy Biswas
বাংলাবাজার রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৫:৫০ অপরাহ্ন, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ | আপডেট: ১:১৪ অপরাহ্ন, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত
  • চেয়ারম্যান-এমডি চক্রের বিরুদ্ধে তদন্ত  চলছে।
  • পূবালীর অংশীদার ডেল্টার ৩৬৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মামলা 

ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে  পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠদের নিয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে বেসরকারি পূবালী ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্ড সিইও মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে কমপক্ষে পাঁচ পরিচালকের একটি দুষ্ট চক্র দীর্ঘদিন থেকে একটি চক্র ব্যাংকটি লুটপাট অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দুদক ডলার পাচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য চেয়ে নোটিশ দিয়েছে। চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শিগগিরই নোটিশ পাঠানো হবে। দুদকের সংশ্লিষ্ট নথি থেকে এই তথ্য জানা গেছে। 

এ দিকে পূবালী ব্যাংকের দুষ্ট চক্রের বিরুদ্ধে পৃথক তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির একজন যুগ্ম-পরিচালকের নেতৃত্বে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, ডলার কারসাজি, অর্থপাচার, নিয়োগে অনিয়ম, বিভিন্ন বন্ধকি সম্পত্তি স্বল্প দামে বিক্রিসহ  বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। ওইসব তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ারও অপচেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। 

আরও পড়ুন: পাম অয়েলের দাম লিটারে কমলো ১৯ টাকা

দুদক সূত্র জানায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে জনৈক ফরহাদ হোসেন পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহম্মদ আলী চক্রের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। সেখানে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্দ আলী, পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক ও অপর পরিচালক খবিরুজ্জামান ইয়াকুবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। নিয়ম লঙ্ঘন করে ব্যাংকটির স্বতন্ত্র পরিচালকদেরকেও ৪-৫ বার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কমিশন অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে। দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় থেকে সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এর সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। 

দুদক সূত্র জানায়, পূবালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকটিতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্র ছায়ায় ফ্যাসিবাদের দোসর একটি শক্তিশালী চক্র ব্যাপক অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্য, ভয়াবহ রকমের ডলার কারসাজি, সম্পত্তি বিক্রি, ঋণ বিতরণের অনিয়মসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় বিক্রয় এবং বাণিজ্যের আড়ালে রহস্যজনক অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত ইতোপূর্বে ক্ষমতার দাপটে বন্ধ হয়ে গেছে। পূবালী ব্যাংকের দুষ্ট চক্রের অন্যতম হোতা ছিলেন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা প্রয়াত এইচটি ইমামের ভাগ্নে মোহাম্মদ আলী। যিনি দীর্ঘ দিন থেকে ব্যাংকটিতে এমডি ও সিইও পদে আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সাইদুর রহমান ও এস.কে সুরের সহযোগিতায় চক্রের সদস্যরা ব্যাংকটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেন। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির একটি চক্র ডলার কারসাকির মাধ্যমে বিপুল অর্থ লুট করে নেন। মোহাম্মদ আলী ডলার কারসাজি, মন্দ ঋণ বিতরণ ও ব্যাংকের সিএসআর ফান্ডের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন এবং আত্মসাৎ করেছেন। 

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত

 বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কিনে ২১১ কোটি টাকা বেশি ব্যয় বা আত্মসাৎ করেছেন। মঞ্জুরুর রহমান ও মোহাম্মদ আলী চক্র কিছু দিন আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের এক্সচেঞ্জ করা শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে না দিয়ে বিদেশে পাচার করেন। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের অভিযানেও এই অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়।

দুদক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির সাত শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক ডেল্টা লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানি।  বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান চক্র ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ২৫ লাখ গ্রাহকের আমানতের ১ হাজার ১৪১ কোটি টাকাসহ মোট  ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিবেশী একটি দেশের কিছু নাগরিক উচ্চ পদে মোটা বেতনে চাকরি দেওয়া হয়েছে। যারা ইসকনের লোক হিসেবে পরিচিত। এই সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। মঞ্জুর রহমান নিজে, স্ত্রী সুরাইয়া রহমান, মেয়ে আদিবা রহমান, ছেলে জিয়াদ রহমান, অপর মেয়ে সাইকা রহমান ও অনিকা রহমানকে পরিচালক পদে বসিয়েছেন। মঞ্জুরের কন্যা আদিবা রহমানকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ দিয়েছেন। তাদের দুর্নীতির বিষয়ে ডেল্টা লাইফের অপর অংশীদার ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের পক্ষে রতন চাকমা বাদী হয়ে রাজধানীর বনানি থানায় মামলা করেছেন। মামলায় আসামীরা ডেল্টা লাইফ ইনসিওরেন্সে নানান কারসাজির মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ২৮ নভেম্বর দায়ের করা মামলাটির নম্বর ৩৩। আসামীরা নানামুখী প্রভাব খাটিয়ে মামলাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগও জমা হয়েছে। সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও অর্থমন্ত্রণালয় থেকেও তাদের দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোন তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।  

 ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্সের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে পূবালী ব্যাংকেও লুটপাট অব্যাহত রাখেন। ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স পূবালী ব্যাংকের শেয়ারধারী হিসেবে পরিচালক হয়েছিলেন মঞ্জুর রহমান। ডেল্টা লাইফের ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ডেটাবেজ সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগ রয়েছে মঞ্জুরুর রহমানে বিরুদ্ধে। 

এছাড়া পূবালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধেও বিশদ অভিযোগ রয়েছে। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে অনিয়ম-জালিয়াতির দায়ে ১০ পরিচালককে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মঞ্জুরুর রহমানের আগে প্রায় এক যুগ পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ আঁকড়ে ছিলেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার জোরে ব্যাংক কোম্পানি আইন আর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কয়েকজন পরিচালক দীর্ঘদিন পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন। এছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী ও এম খাবিরুজ্জামান ইয়াকুবসহ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা বলে দুদকে জমা হওয়া নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া খাবিরুজ্জামান ইয়াকুব চান্দ্রা স্পিনিং মিলের নামে শতকোটি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। 

অভিযোগে আরও বলা হয়, সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সের চেয়ারম্যান। তার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মঞ্জরুরুর রহমান। তারা দুজনই প্রায় দেড়যুগ ধরে পূবালী ব্যাংক ও ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সের চেয়ারম্যানের পদ দখল করে লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎ করছেন। 

পূবালী ব্যাংকের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বাংলাবাজার কে বলেন, এই বিষয়ে আমার কাছে এখনো কোন তথ্য আসেনি। তদন্ত চলমান। আর কিছু বলতে পারবো না।

দুদকের উপপরিচালক মো. আখতার হোসেন বলেন, অভিযোগ জমা হওয়ার পর আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, একটি পক্ষ ব্যাংকটিকে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার করছে। দুদকে একটি তদন্ত চলছে। তারা কিছু তথ্য চেয়েছে। আমরা সেগুলো দিচ্ছি। জিজ্ঞাসাবাদের কোনো নোটিশ আমরা পাইনি।