যে স্কুলের বয়স ১৯০ বছর হলো
ঢাকা সদরঘাটের নিকট ‘১ নম্বর লয়াল স্ট্রিট’-এর এক চৌকোনা ভবনে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই সূচিত হয় অখন্ড ভারতের প্রথম সরকারি স্কুলের পথচলা। এর নাম ছিল ‘ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি’। ঐতিহাসিক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই পরবর্তীকালে ১৯৪১ সালে জন্ম দেয় ঢাকা কলেজের, এরপর স্কুল শাখার নাম ‘ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি’ পরিবর্তন হয়ে ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল’ করা হয়, এটি এক বিস্ময়কর যাত্রার নাম, যার আলো এখনো ছড়ায়।
বর্তমানে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. হাবিব উল্লাহ খান। প্রভাতি ও দিবা শিফট মিলিয়ে স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২,০৩৪ জন, আর শিক্ষক সংখ্যা মাত্র ৩৮ জন, যদিও খাতাকলমে পদ রয়েছে ৫৩টি। শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি ক্লাসরুম ও খেলার মাঠের অভাবও প্রকট। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা হচ্ছে করোনার পর শিক্ষার্থীদের পাঠে আগ্রহ হ্রাস।
আরও পড়ুন: জাতীয় ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখা কমিটি ঘোষণা
বিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. নোমান হোসাইন জানান, আমি ১৯৯২ সাল থেকে এখানে আছি। দেশের শিক্ষাবিস্তারে এ বিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য।" সহশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে বিতর্ক, কুইজ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্কাউটস, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট ইত্যাদি।
স্কুলটির শুরুর দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ঢাকা জেলার কালেক্টর স্কিনার হন গভর্নিং বডির সভাপতি এবং জেলা সার্জন ডা. জেমস টেইলর হন সচিব। প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ইংরেজ শিক্ষক মি. রিজ। ১৯০৮ সালের জুন পর্যন্ত এটি ঢাকা কলেজের অধীনে পরিচালিত হলেও পরে শিক্ষা পরিদর্শকের অধীনে নেওয়া হয় এবং জিলা স্কুল হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।
আরও পড়ুন: জুলাই-বিপ্লববিরোধী ভূমিকার অভিযোগে ৩০ শিক্ষক-কর্মকর্তা বরখাস্ত
১৮৭২ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় শিক্ষকরাই পরিচালনায় ছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম প্রধান শিক্ষক হন কৈলাস চন্দ্র ঘোষ, এরপর আসেন রত্ন মণি গুপ্ত (১৮৮৮-১৮৯৬)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তখনকার প্রেসিডেন্সি বেঙ্গলের ৯ বার এসএসসি পরীক্ষায় ৮ বারই প্রথম হয়েছিল এই স্কুল।
পাকিস্তান স্বাধীনতার পর শাসকগোষ্ঠী স্কুল ভবন দখল করে সেখানে গড়ে তোলে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ভবনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও পরে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব ভবনে চলে যায়, তবু কলেজিয়েট স্কুলের মূল ভবন ও জায়গা আর ফেরত দেওয়া হয়নি। এটি এক সময় জগন্নাথ কলেজকে দেওয়া হয়। এই অন্যায় সিদ্ধান্তে ব্যথিত হয়েছিলেন অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৈয়দ শামসুল হক এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের গর্বিত ছাত্রদের মধ্যে আছেন, ঢাকার নবাব আব্দুল গণি, উদ্ভিদবিদ স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা, কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি বুদ্ধদেব বসু, শহিদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন, প্রকৌশলী ড. ইকবাল মাহমুদ সহ অনেকেই।
এই দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রেখে, শিক্ষার শিখা প্রজ্বলিত করে চলেছে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল একটি প্রতিষ্ঠান, যা শুধু একটি স্কুল নয়, বরং বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রগতিশীল চেতনার এক অনন্য প্রতীক।





