ডেঙ্গুর প্রকোপ

হু হু করে বাড়ছে মশা ঠেকানোর পণ্যসামগ্রীর দাম ও চাহিদা

Shakil
মোয়াজ্জেম হোসেন
প্রকাশিত: ১:৪১ অপরাহ্ন, ০৭ অগাস্ট ২০২৩ | আপডেট: ১১:২৭ পূর্বাহ্ন, ০৬ অগাস্ট ২০২৫
সংগৃহীত
সংগৃহীত

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মশা ঠেকানোর সামগ্রীর চাহিদা ও দামও বাড়ছে। মালিবাগের শহীদ স্টোরে আগে প্রতিদিন মশার কয়েল বিক্রি হতো হাতেগোনা কয়েকটি। আর এখন সেই কয়েলের বিক্রি কমতি নেই। তবে দেশি কয়েলের চেয়ে বিদেশি চাইনিজ কয়েলের চাহিদা বেড়েছে। কেন দেশি কয়েলের চাহিদা কমে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ সেই বিক্রেতা। তবে তিনি বলেন, দেশি কয়েলের সরবরাহ আগের তুলনায় কমে গেছে।

শান্তিনগরের এক দোকানির কাছে দেশি কয়েল চাওয়া হলে তিনি সাফ জবাব দিলেন, নেই। কেন নেই? একই প্রশ্ন করতে তিনি জানালেন, আগে যারা দেশি কয়েল নিয়ে আসত এখন তারা আসে না। অর্থাৎ ভেজাল কয়েলের দৌরাত্ম্য কমেছে। তবে বিদেশি কয়েলের বেচাকেনা এখন জমজমাট।

আরও পড়ুন: আটকে আছে মালয়েশিয়া শ্রমবাজার

সারা দেশে ডেঙ্গু মশার কারণে কয়েলের দাম যেমন বেশি বিক্রি হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিক্রি বেড়েছে বিভিন্ন কোম্পানির অ্যারোসেল। যা মশা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। অ্যারোসেল বিক্রি বেড়েছে ঠিকই, এর সঙ্গে দামও বেড়েছে। আর এই বাড়তি দাম কোনো কোম্পানি আরোপ করেনি। করেছে এক শ্রেণির ডিলার ও দোকানদাররা। অ্যারোসেল কি মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? এই প্রশ্ন উথাপন করা হয়েছিল এসিআই চেয়ারম্যান এম আনিসউদ্দৌলাকে। তিনি জানান, অ্যারোসেল মশা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। ঘর বন্ধ করে অ্যারোসেল দিলে মশা বেহুশ হয়ে পড়ে। আর বেশিক্ষণ যদি ঘর জানালা বন্ধ রাখা যায় তা হলে মশা মরে যাবে। অ্যারোসেলে ডেঙ্গু মরবে কি না? অপর এক প্রশ্নে তিনি জানান, অবশ্যই মরবে।

রাজধানীর কয়েকটি বাজার সরজমিনে দেখা গেছে, আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে, মশারি, কয়েল ও অ্যারোসলসহ নানা কোম্পানির মশা তাড়ানোর স্প্রে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা মশারির। বর্তমানে ৩ বাই ৪ ফিট থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ বাই ৯ ফিট সাইজের মশারি বাজারে পাওয়া যায়। এর মধ্যে সিঙ্গেল বা ৩ বাই ৪ ফিট সাইজের চাহিদা বেশি। এসব মশারির দাম ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৮০০ টাকা পর্যন্ত চাচ্ছেন বিক্রেতারা। অথচ কিছুদিন আগে এসব সাইজের মশারির দাম ১০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। তবে মশারির মান ও আকৃতিভেদে ৬০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: কানাডায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার নিবন্ধন উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন সিইসি

কাওরানবাজার কিচেন মার্কেটের বিপরীতে ফুটপাথের মশারি বিক্রেতা মানিক মিয়া জানান, ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির পর থেকে মশারির চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। আগে যেখানে দিনে ৫০ থেকে ১০০ পিস বিক্রি হেতো। এখন সেখানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ২০০ পিস। কোনো কোনো দিন দোকানে নিয়ে আসা সব মশারি শেষ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি দাম বেড়েছে। পাইকারি বাজারেই প্রতি পিস ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর সঙ্গে আমরা আরো কয়েক টাকা বেশি ধরে বিক্রি করছি। তার মতে, আসলে আমাদের করার কিছুই নেই। কারণ বেশি দামে কিনে আনি, বেশি দামে বিক্রি করি। আরেক ব্যবসায়ী নাজিম জানান, ক্রেতা বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। আগে যে মশারি ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় ক্রয় করতে পারতেন ব্যবসায়ীরা- ওই মশারি এখন পাইকারি দামে ১৫০ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। যে কারণে দোকান থেকে তা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। আর যে মশারি ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় ক্রয় করতেন ব্যবসায়ীরা সেটা এখন ২২০ থেকে ২৩০ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেতে ৩৫০ টাকায়।

এদিকে মশারির পাশাপশি মশা মারার বৈদ্যুতিক ব্যাটের প্রতিটির দাম কয়েক সপ্তাহ আগে ছিলো ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এখন তা ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে কাওরান বাজারের ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেটের ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, ব্যাটগুলো এখনো দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হয় না। বাইরে থেকে আসে। ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়ে গেছে।

ওডোমস ও রোলঅন ক্রিমের চাহিদা বেশ বেড়েছে। মশা থেকে রক্ষা পেতে ক্রিমগুলো কিনছেন ক্রেতারা। বাজারে ওডোমস অয়েন্টমেন্ট ১০০ গ্রাম ক্রিম অন্য সময়ে ২০০ টাকার কম দামে বিক্রি হয়। এখন তার দাম বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা। ক্রেতারা জানিয়েছেন, দাম বেশি দিয়েও ক্রিম পাওয়া যাচ্ছে না ওষুধের দোকানগুলোতে।

বাজারে মশা মারার স্প্রে ক্যানপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ টাকা দাম বেড়েছে। হিট ব্র্যান্ডের ৪৭৫ মিলি লিটারের স্প্রে ২৭০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই ব্র্যান্ডের ৮০০ মিলির স্প্রে ক্যান ৪২০ টাকা ছিল। তা বেড়ে ৪৫০ থেকে ৪৭০ টাকা হয়েছে। অন্যান্য ব্র্যান্ডের মধ্যে আগে ছোট স্প্রে ক্যান ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও তা এখন ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কাওরান বাজার কিচেন মার্কেটে দ্বিতীয় তলার বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সের মালিক সেলিম হোসেন বলেন, মশার স্প্রের বিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে। আগে মাসে ২০ থেকে ২৫ কার্টন (প্রতিটিতে ১২টি করে) স্প্রে বিক্রি হতো। গত ৩ দিনেই প্রায় ৪০ কার্টন স্প্রে বিক্রি হয়েছে। অ্যারোসল ক্যানের দাম সামান্য বেড়েছে বলে জানান তিনি। অ্যারোসল ৪৭৫ এমএল ক্যানের দাম ২৬০ টাকা। আর ৮০০ এমএমল ক্যান ৪০০ টাকা।

একাধিক ভোক্তা অভিযোগ করেছে, ডেঙ্গুর সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ছোট ব্যবসায়ী বেশি মুনাফা করছে। আর মুনাফার একটা মাত্রা আছে। কিন্তু মুনাফার মাত্রা বেশি বলে মনে হচ্ছে। আবার কেউ কেউ কৃত্রিম সংকটের দোহাই দিয়ে পকেট কাটছে ভোক্তাদের। গত দুই থেকে ছয় মাসের ব্যবধানে প্রতিটি পণ্যের দাম ১০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। 

কোনো পরিবারের সদস্যের সামান্য একটু জ্বর হলে শরণাপন্ন হতে হচ্ছে আশপাশের ডাক্তারের কাছে। মালিবাগের মেডিনোভা আর পদ্মায় এই সামান্য জ্বরের পরীক্ষার কমতি নেই। পরীক্ষা করাতে কাউকে বেশি টাকা গুণতে হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শান্তিনগরের পপুলার,সায়েন্স ল্যাবরেটরির পপুলারের ভিড়ের কমতি নেই। এই ভিড় শুধুই পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষা করতে আসা একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কাছে পরীক্ষার জন্য ৫০০ টাকার বেশি নেওয়া হচ্ছে।

ওষুধের দোকানও এখন বেশ জমজমাট। জ্বরের ওষুধ বিক্রির কমতি নেই। কারণ একটু শরীর ব্যথা হলে কিংবা জ্বর জ্বর ভাব হলেই অনেকে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধের দোকানে ছুটছে। বিখ্যাত একটি ফার্মেসি ৪০০ টাকার ওষুধ বিক্রি করছে ৬০০ টাকায়। মহল্লায় ছোট ছোট ওষুধের দোকানগুলো পাল্লা দিয়ে ওষুধের দাম বেশি নিচ্ছে। ডেঙ্গুর ভয়ে অনেকে স্যালাইন কিনছেন। কিন্তু সেই স্যালাইনের দামও এখন আগের মতো নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক ওষুধের দোকানে শুধু স্যালাইন বিক্রি বেশি হচ্ছে। চাহিদা বিপরীতে দামও বাড়ছে।

প্রায় প্রতিটি হাসপাতালের সামনে কম-বেশি ফল বিক্রি হয়। এর পাশাপাশি ডাব। এখন ডেঙ্গু রোগীদের জন্য অনেকে মালটা কিনছেন। আবার অনেকে ডাব কিনছেন। তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই মালটা ও ডাবের দাম অনেক বেশি মনে হচ্ছে। এর পাশাপাশি বাজারেও এই পণ্যের দাম চড়া। বাজারে ডেঙ্গু রোগীর পথ্যের দাম শুনে অনেকে হতবাক। একটি ডাবের দাম ৭০-৮০ টাকা। মাসখানেক আগে যা ছিল ৩০-৫০ টাকা। বেড়েছে ফলের দাম। কমলা হালি এখন ২০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আনার ২৫০-৩০০ টাকা। আগে এর দাম ছিল ১৮০-২০০ টাকা। আনারস বাজারে প্রচুর সরবরাহ থাকলেও কমতি নেই দামে।

ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা এখন খুঁজছেন মশা প্রতিরোধক ক্রিম, ওডোমস ও ভারতীয় লোশন। আগে এই সব পণ্যের দাম আগে যা ছিল এখন চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে দামও বাড়তির দিকে। যে লোশনের দাম ছিল ১০০-১৫০ টাকা। আর এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫০০ টাকায়। অনেকে এই ওডোমস, লোশন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দাম নেওয়ার চেষ্টা করছে। তারাও জেনে গেছেন, এসব পণ্য মশা নিধোরকের জন্য সহায়ক।

ডেঙ্গু থেকে রক্ষার উপায়
সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার না করলে সিগারেটের চেয়েও বেশি ক্ষতি করতে পারে মশার কয়েল। কয়েলের ধোঁয়া ফুসফুসের ক্ষতি করে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘কয়েলে কীটনাশক ব্যবহারের একটি মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও), কিন্তু দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেনামে যে কয়েল উৎপাদন করা হয় সেগুলোতে তার চেয়ে বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, যা ঠিক না। তবে বড় বড় কম্পানি, যারা বিএসটিআইয়ের অনুমতি নিয়ে কয়েল প্রস্তুত করছে, তাদের মধ্যে বেশি কীটনাশক ব্যবহারের প্রবণতা নেই। তাদের কয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।’

মশা তাড়ানোর উপকরণ ব্যবহারের চেয়ে সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করেন এই কীটতত্ত্ববিদ। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে প্রথমত নিশ্চিত করতে হবে, বাসার আশপাশে যেন পানি জমে না থাকে। জমে থাকলে পানি ফেলে দিতে হবে। যে পানি ফেলে দেওয়া সম্ভব নয় তার মধ্যে কেরোসিন তেল বা মবিল ঢেলে দিতে হবে। এরপর বাসায় মশারি ব্যবহার করতে হবে। সন্ধ্যার আগেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে হবে। হাফ হাতা শার্ট পরা যাবে না। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর আগে মোজা, ফুল হাতা শার্ট পরিয়ে দিতে হবে। অফিসে যাঁরা যান তাঁদেরও হাফ হাতা শার্ট পরা বাদ দিতে হবে। এর বাইরে স্প্রে, ক্রিম ব্যবহার করতে হবে।

বিএসটিআইয়ের নির্দেশনা না মেনে কেউ কয়েল উৎপাদন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি ডিরেক্টর ও মুখপাত্র মো. রেজাউল হক। তিনি বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠান আমাদের অনুমতি ছাড়া মশার কয়েল প্রস্তুত করছে সেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। অভিযান পরিচালনা করছি।’