বিজয় র্যালিতে তারেক রহমান: গণতন্ত্র অভিযাত্রায় ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান

গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় জাতীয় স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান উপলক্ষে বুধবার (৬ আগস্ট) রাজধানীতে আয়োজিত বিজয় র্যালির আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এই আহ্বান জানান।
তারেক রহমান বলেন, "প্রিয় রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মতভেদ থাকবে। কিন্তু সেই ভিন্ন মত নিরসনে আলোচনা হবে। তবে জাতীয় ইস্যুতে এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেন মুখ দেখাদেখি বন্ধ না হয়, সেই লক্ষ্যে জাতীয় স্বার্থে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। কারণ আমি বিশ্বাস করি, ধর্ম, দর্শন, মত যার যার, রাষ্ট্র আমাদের সবার।"
আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি
তিনি আরও বলেন, জনগণের রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে বিএনপি কেমন সরকার ও রাজনীতি পরিচালনা করবে, সে বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে '৩১ দফা' রূপরেখা জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশ ও জনগণের কল্যাণে এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা চায়।
নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিকেল সাড়ে তিনটায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শুরু হয়। তারেক রহমানের বক্তব্যের পর বিকেল সাড়ে চারটায় শুরু হয় বর্ণাঢ্য বিজয় র্যালি।
আরও পড়ুন: আগামী নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বড় চ্যালেঞ্জ: সিইসি
র্যালিতে ঢাকা মহানগর ছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল জেলা থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ব্যানার-ফেস্টুন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা নিয়ে অংশ নেন। ফকিরাপুল থেকে কাকরাইল পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, মহিলা দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মীও র্যালিতে অংশ নেন। র্যালিটি বিজয়নগর, পল্টন মোড়, জাতীয় প্রেসক্লাব, কদম ফোয়ারা, মৎস্য ভবন মোড়, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন সড়ক হয়ে শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়।
ঢাকা ছাড়াও দেশের সব বিভাগীয় শহরে একযোগে বিজয় র্যালির কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি।
তারেক রহমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, "ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের জনগণের সরাসরি ভোটে দায়বদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গতকাল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি সময়সীমা ঘোষণা করেছে। জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের দাবিতে জুলাই সনদ ঘোষণা করা হয়েছে। জনগণের অধিকার বাস্তবায়নের এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।"
তিনি বলেন, "গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে বর্তমানে আমরা ইতিহাসের যে সন্ধিক্ষণ পার করছি, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির জন্য দেশের গণতান্ত্রিক জনগণকে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের দীর্ঘ সময়ে এই আন্দোলনে আমরা হাজার হাজার সহকর্মীকে হারিয়েছি, অনেক সন্তান-স্বজনের বুকের তাজা রক্ত দেখতে হয়েছে।"
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, বিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দেওয়া হয়েছে। অনেক নেতার বিরুদ্ধে শত শত মামলা আছে। গুম ও অপহরণের শিকার হয়েছেন শত শত নেতাকর্মী। শুধু ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেই দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
তারেক রহমান বলেন, "পরাজিত ফ্যাসিস্টের আমলে দেশে অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। আজকের এই বিজয় মিছিল অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোর পথে যাত্রা। তবে এই যাত্রা খুব সহজ নয়।"
তিনি বলেন, "বর্তমানে দেশের জনগণের সামনে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অপার সম্ভাবনা এবং সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা যদি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জনগণের রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। দেশকে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবে না এবং আমাদেরকে আর কখনো '২৪-এর দৃশ্য দেখতে হবে না।"
তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা, পরিবারের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
তারেক রহমান বলেন, "আমি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, যিনি যে রাজনৈতিক দলের সদস্যই হন না কেন, আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে ফ্যাসিস্ট শাসন আমলে আমরা কেউই নিরাপদ ছিলাম না, আমাদের সন্তানেরাও কেউ নিরাপদ থাকতে পারেনি। আমাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, সকল গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে সমগ্র বাংলাদেশকেই বর্বর বন্দিশালা, 'আয়নাঘর' বানিয়ে ফেলা হয়েছিল।"
তিনি আরও বলেন, "দেশে যদি গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন না থাকে, তাহলে নারী-পুরুষ, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু—কেউই নিরাপদ নই। একমাত্র গণতন্ত্র ও আইনের শাসনই আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারে। জনগণের গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে এবং রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর সঠিক চর্চা করা উচিত।"
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর সভাপতিত্বে এবং প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, সালাহ উদ্দিন আহমদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির রফিকুল আলম মজনু, উত্তর বিএনপির আমিনুল হক প্রমুখ।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর বক্তব্যে বলেন, "তারেক রহমানের নেতৃত্বেই আগামীতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে।" তিনি বলেন, "নির্বাচনের তারিখ খুব শিগগিরই ঘোষণা হবে। আমাদের জুলাই ঘোষণাপত্র হয়েছে, তারেক রহমানের ৩১ দফার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়িত হতে চলেছে সংস্কারের মধ্য দিয়ে।" তিনি স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার শপথ নেওয়ার আহ্বান জানান।
মির্জা ফখরুল এই বিজয় অর্জনের জন্য দেশের মানুষ, রাজনৈতিক দল, ছাত্র এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, এই বিজয় একদিনের বা ৩৬ দিনের সফলতা নয়, এটি ১৭ বছরের আন্দোলনের ফসল। তিনি বলেন, "আজকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কেউ এক-এগারোর ষড়যন্ত্রে আছে।" তবে সব ভুল-ভ্রান্তি মেনে নিয়েও তিনি গতকালের ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানান এবং বৃহত্তর গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার গুরুত্বের ওপর জোর দেন।
র্যালিতে বিএনপির আসাদুজ্জামান রিপন, আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, শাহজাদা মিয়া, আফরোজা খান রিতা, লুৎফুজ্জামান বাবর, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ফজলুল হক মিলন, মীর শরাফত আলী সপু, ডা. রফিকুল ইসলাম, কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, হুমায়ুন কবির খান, তাইফুল ইসলাম টিপু, আব্দুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল, কাদের গণি চৌধুরি, ডা. মাজহারুল আলম, মুনায়েম মুন্না, রাকিবুল ইসলাম রাকিব, এসএম জিলানি, নুরুল ইসলাম নয়ন, আফরোজা আব্বাস, সুলতানা আহমেদ, আবুল কালাম আজাদ, রাজিব আহসান, নাসির উদ্দিন নাসিরসহ কেন্দ্রীয়, অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।