অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর: সাফল্য, সীমাবদ্ধতা ও আগামী পথচলা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক যুগান্তকারী অধ্যায়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এক বছর পূর্ণ করেছে। গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, তিন দিনের নির্বাহী শূন্যতার অবসান ঘটিয়ে ৮ আগস্ট শপথ নেন ড. ইউনূস। এরপর থেকেই শুরু হয় এই অন্তর্বর্তী সরকারের পরীক্ষামূলক যাত্রা, যার মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, অর্থনীতির ওপর জনআস্থা তৈরি এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ প্রস্তুত করা।
প্রথম বছরের সাফল্য ও সংস্কার
আরও পড়ুন: ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে নিবার্চন: সিইসি
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ড. ইউনূস সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, 'জুলাই সনদ' প্রণয়ন, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তৈরি করেছে। এই সনদটি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংস্কারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। সরকার ঘোষণা করেছে যে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচন কমিশন এ বছরের ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার এক বছরে মোট ৯টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে: নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, বিচারব্যবস্থা সংস্কার, দুর্নীতি দমন সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কার, স্বাস্থ্য সংস্কার, গণমাধ্যম সংস্কার, শ্রমিক অধিকার সংস্কার, নারী বিষয়ক সংস্কার।
আরও পড়ুন: ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছেন হজযাত্রীরা
এই কমিশনগুলো ইতোমধ্যে তাদের সুপারিশমালা জমা দিয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা বৃদ্ধির প্রস্তাব আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়েছে।
অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ছিল সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জুনে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৮.৪৮ শতাংশে, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। যদিও জুলাইয়ে তা সামান্য বেড়ে ৮.৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও স্থিতিশীলতা এসেছে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের আস্থা বাড়ায় গত ১১ মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার সুদ ও আসল পরিশোধ করেও রিজার্ভ বেড়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঋণ পরিশোধের রেকর্ড।
জনআস্থা ও সীমাবদ্ধতা
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি তরুণ প্রজন্ম ও প্রবাসীদের মধ্যে একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তবে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের সুফল এখনও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এখনও রয়ে গেছে। গ্রামীণ অঞ্চলে বেকারত্ব এবং দ্রব্যমূল্যের চাপ এখনও একটি বড় সমস্যা।
আগামী দিনের পথচলা
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা এবং গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। একই সঙ্গে, সংস্কারগুলো টেকসই করা এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ কমানোও তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শুধু এই অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকারিতার পরীক্ষা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে।