অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার দাবি

ডিবি হাজতে নির্যাতনে সন্দেহভাজন আসামির মৃত্যু

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৬:২২ অপরাহ্ন, ২১ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৬:২২ অপরাহ্ন, ২১ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

ঢাকার আলোচিত ডিবি কার্যালয়ের হাজতে এবার অতিরিক্ত নির্যাতনে সন্দেহভাজন এক আসামির মৃত্যু হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ গণপিটুনিতে আহত হওয়ার পর মৃত্যুর দাবি হলেও পরিবার বলছে, পুলিশ তাকে আটকের পর প্রকাশ্যে মানুষের সামনে নির্মম নির্যাতন করেছে। গুরুতর আহত হলেও তাকে কোন চিকিৎসা করতে দেয়া হয়নি। তার সামনেই তার কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে অমানবিক নির্যাতন করেছে। পিতা-পুত্রকে ধরে নির্যাতনের পর ডিবি হাজতে আলাদা রেখে দেয়া হয়। সকালে পিতা মুক্তারকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অতিরিক্ত নির্যাতনে কোন চিকিৎসা না করায় মুক্তারের মৃত্যু হয় বলে পরিবারের দাবি।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তার স্ত্রী অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার করে বিচারের দাবি করেছেন।

আরও পড়ুন: ‘গোয়েন্দা টিম গঠন করেন, লোক সাপ্লাই দেব’ ওসিকে জামায়াতের প্রার্থীর মন্তব্যে বিতর্ক

ডিবি কার্যালয়ে হাজত খানায় রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হওয়া যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া হত্যার সন্দেহজনক আসামি ব্যবসায়ী মুক্তার হোসেনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য দুপুরের পর পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। খবর দেওয়া হয় পরিবারের সদস্যদের। প্রথমে খবর জানানো হয় একই হাজতকানার অন্য রুমে আটক এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া ছেলে মামুন হোসেন মৃদুলকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিতার মৃত্যুর খবর দিয়ে ডিবির হাজতকানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর পরিবারের সদস্যরা আসেন ডিবি কার্যালয়ে।

তাদের সাথে ডিবি কর্মকর্তাদের চরম দুরব্যবহারের অভিযোগ করেছেন নিহতের স্ত্রী মুক্তা বেগম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গোয়েন্দা হাজত থেকে মুক্তার মামুন হোসেন মৃদুল জানায়, তার পিতা মুক্তার হোসেনকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ধ ব্লকের বাসার সামনে থেকে ডিবি পুলিশ আটক করে গাড়িতে তুলে রাখে। গাড়ির ভিতরে আমাদের সামনেই পুলিশ তাকে অমানবিকভাবে লাঠিপেটা করে। আমি এবং আমার মা এ সময় তাকে আটক ও নির্যাতনের কারণ জিজ্ঞেস করলে পুলিশ আমাকেও ধরে সকলের সামনে লাঠিপেটা দেয়। আমার পিতার সামনে আমাকে নির্মমভাবে লাঠিপেটা করায় বাবা অজুহাতে কাঁদছিলেন। এতেই পিতা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃদুল আরও জানান, আমাকে পিটানোর পর অন্য একটি গাড়িতে গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নেয়। দীর্ঘ সময় ধরে তারা এখানে আমাদের আটকে রেখে সিনিয়র অফিসার আসার কথা বলে আমাদের নির্যাতন করে। রাতে আমাকে ডিবি হাজতে নিয়ে লাঠিপেটা করে অন্য রুমে থাকতে দেয়।

আরও পড়ুন: লাভেলো আইসক্রিমের এমডি-চেয়ারম্যানসহ চারজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সকালে আমাকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে আমার পিতা মারা গেছে। আমার পিতার উপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর কোন চিকিৎসা করা হয়নি। পরিবারের সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে অভিযুক্ত খুনি পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। হাসপাতাল মর্গে নিহতের স্ত্রী মুক্তা বেগম বলেন, আমার স্বামী নিরপরাধ। তিনি কোন মামলার আসামি নন। দীর্ঘদিন ধরে পুরান কাপড়ের ব্যবসা করতেন। আমার স্বামী আটক হওয়ার পর তার সামনেই আমাদের কিছু ছেলে নির্যাতনের ঘটনা সহ্য করতে পারেননি। আমি স্বামীর হত্যার বিচার চাই।

এদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ মুক্তার হোসেন মৃত্যুর বিষয়ে একটি প্রেস রিলিজ দিয়েছে গণমাধ্যমগুলোর কাছে। তাতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় আটক ব্যক্তির মৃত্যু প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, রাজধানীর পল্লবীতে কয়েকজন অস্ত্রধারীর এলোপাতাড়ি গুলিতে গোলাম কিবরিয়া নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। এই ঘটনায় পাঁচজন এজাহারনামীয় ও ৭–৮ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের লক্ষ্যে মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। এই প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ঘটনার সাথে জড়িত নজরুল, মাসুম ও জামান নামে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করে এবং ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি মোঃ মুক্তার হোসেনের হেফাজতে আছে বলে জানায়। তাদের তথ্য অনুযায়ী মুক্তারকে আটক করতে ডিবির একটি টিম বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) সন্ধ্যা আনুমানিক ৬.০০ ঘটিকায় রাজধানীর পল্লবী এলাকায় একটি গ্যারেজে অভিযান পরিচালনা করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় কৌশলে তাকে আটক করা হয়।

আটককৃত মুক্তার হোসেনকে (৪০) পরবর্তীতে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। রাত আনুমানিক ১.৩০ ঘটিকায় সে অসুস্থ বোধ করলে তাৎক্ষণিক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কিছু ওষুধপত্র দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র প্রদান করা হলে পুনরায় তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।

শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল আনুমানিক ১০.০০ ঘটিকায় তাকে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করা হলে কোন সাড়াশব্দ না পাওয়ায় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্তের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) মোঃ সরওয়ার, বিপিএম-সেবা এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

পুলিশের দেওয়া এই বক্তব্যকে নিহত মুক্তার হোসেনের স্ত্রী মুক্তা বেগম সাজানো বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, পুলিশের এই বক্তব্য অন্যান্য ক্রসফায়ার ও গুম হওয়ার পরের বক্তব্যের মতোই। আমাদের চোখের সামনে পুলিশ তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। বিশেষ করে বাবার সামনে ছেলেকে পুলিশের নিষ্ঠুর নির্যাতন সহ্য করতে পারেননি। মুক্তা বেগম নির্যাতনকারী পুলিশ সদস্যদের অফিসারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবী জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।