মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা বাড়ছে

জানুয়ারিতে নতুন বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা

Sanchoy Biswas
খালিদ আহমেদ
প্রকাশিত: ৯:৫২ অপরাহ্ন, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৯:৫২ অপরাহ্ন, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত
  • শিখন প্রক্রিয়া ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা বিশ্লেষকদের
  • সামান্য দেরি হলেও বড় বিঘ্ন ঘটবে না- অর্থ উপদেষ্টা
  • নির্বাচন পাঠ্যবই বিতরণে কোন প্রভাব ফেলবে না
  • জানুয়ারির মধ্যে ৭০ শতাংশ বই দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার-বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান

নতুন শিক্ষাবর্ষ (২০২৬) শুরু হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকলেও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। প্রাথমিক স্তরের শতভাগ বই মুদ্রণ ও সরবরাহ সম্পন্ন হলেও দরপত্র জটিলতা ও সময়স্বল্পতার কারণে মাধ্যমিকের বই ছাপা ও বিতরণ কার্যক্রম পিছিয়ে পড়েছে। এনসিটিবি জানালেও যে জানুয়ারির মধ্যেই সব বই পৌঁছে দেওয়া হবে, বাস্তবতায় তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা ও শিক্ষা বিশ্লেষকেরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছে, প্রাথমিকের শতভাগ বই মুদ্রণ ও সরবরাহ সম্পন্ন হলেও দরপত্র জটিলতার কারণে মাধ্যমিকের বই ছাপার কাজ বিলম্বিত হয়েছে। তবে জানুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বছর শেষ হতে বাকি আর মাত্র ১২ দিন। তাই নতুন বছরের পাঠ্যবই নিয়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় ছাপার কাজ শেষ করতে ব্যস্ততা চলছে বিভিন্ন প্রেসে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ের ছাপা থেকে বাঁধাই, কাটিং ও প্যাকেজিংয়ে সংশ্লিষ্টদের যেন ফুরসত নেই। নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩০ কোটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে প্রাথমিকের ৯ কোটির সব বই ছাপা শেষে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এখনো মাধ্যমিকের বেশিরভাগ বই ছাপাই শুরু করেনি অধিকাংশ প্রেস। মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দেরি করায় সময়মতো কাজ শুরু করতে পারেনি অনেক প্রেস। বর্তমানে যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বই ছাপা হতে পারে। আর সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে না পারলে শিখন প্রক্রিয়া ঘাটতিতে পড়বে বলে শঙ্কা বিশ্লেষকদের। এনসিটিবি সূত্র বলছে, নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩০ কোটি বই ছাপার কাজ চলছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিকের ৯ কোটি এবং মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ির ২১ কোটি বই। প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ শেষ হয়েছে। এসব বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানোও হচ্ছে। তবে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ১২ কোটি ৬০ লাখের বেশি বই ছাপানোর জন্য সম্প্রতি প্রেসের সঙ্গে চুক্তি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। হাতে গোনা কয়েকটি প্রেস মাত্রই ছাপানোর কাজ শুরু করেছে। চুক্তি অনুযায়ী, এই বই ছাপাতে সময় পাবেন ৫০ দিন। মুদ্রণ শিল্প সমিতি বলছে, এনসিটিবি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির প্রথমবারের টেন্ডার বাতিল করায় ছাপানোর কাজে দেরি হয়েছে। তাই জানুয়ারিতে কোনোভাবেই সব বই পাবেন না শিক্ষার্থীরা। এনসিটিবির অপর একটি সূত্র জানায়, প্রাইমারির সব বই ছাপা হয়েছে এবং তা পাঠানো সম্পন্ন হয়েছে। নবম শ্রেণির বই মুদ্রণ এবং পাঠানো সম্পন্ন হয়েছে। ষষ্ঠ সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ৮০ শতাংশ বইয়ের ছাপার কাজ সম্পন্ন। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অধিকাংশ বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে।  বাকী শিক্ষার্থীরা জানুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যে বই পাবেন। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে জাতীয় নির্বাচন, রোজা ও ঈদুল ফিতরের লম্বা ছুটি। তাই জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তবে জানুয়ারির মধ্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, পাঠ্যবই ছাপানোর যে গতিতে চলছে, তাতে জানুয়ারির মধ্যে ২৫ শতাংশ পাঠ্যবইও শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বলছে, জানুয়ারিতেই বই পাবেন শিক্ষার্থীরা। এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, জানুয়ারিতে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই তুলে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সবাই আশাবাদী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সায়্যেদা আতিকুন নাহার বলেন, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যবই মেইন সোর্স হিসেবে কাজ করে। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই না পেলে সমস্যা হবেই। এছাড়া শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতে অনেক আগ্রহ নিয়ে নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষা করে; সেটা সময়মতো না পেলে শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। তিনি বলেন, সমস্যাটা দীর্ঘদিনের; গুটিকয়েকটি প্রেসের মধ্যে কাজ সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার বিষয়ে সরকারের তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমরা বারবার শিক্ষা কমিশন গঠনের কথা বলেছি; কিন্তু তা আজও হয়নি। পৃথিবীর সব দেশে যখন শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে, আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কারিক্যুলাম সেই ১৫ বছর আগেরটাই থেকে গেছে। তিনি বলেন, কারো গাফিলতির কারণে যাতে শিক্ষার্থীদের হাতে বইগুলো যেতে দেরি না হয়, সে ব্যাপারে সুষ্ঠু পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, জানুয়ারির মধ্যে ৭০ শতাংশ বই দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। নরমালি ছাপার কাজের যে গতি আছে, তাতে ৪০ শতাংশ বই জানুয়ারিতে যেতে পারে। তবে সবাই উদ্যোগী হলে, সংকটগুলোর ওপর নজর দিয়ে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বই পৌঁছে যেতে পারে। সম্প্রতি সাংবাদিকদের আলাপকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণ কার্যক্রমে বড় ধরনের কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। কিছু বইয়ের ক্ষেত্রে পুনঃটেন্ডারের প্রয়োজন হয়েছিল। তবে সার্বিক অনুমোদন প্রক্রিয়া এখন সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, যে বইগুলো পেন্ডিং ছিল, সেগুলোর জন্য আমরা পুনঃটেন্ডার চেয়েছিলাম। আগের সব অনুমোদনও নিষ্পত্তি হয়েছে। আমরা আশা করছি সময়মতো বই পাওয়া যাবে। সামান্য কিছু দেরি হতে পারে; তবে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটার কথা নয়। ঠিক কতদিন দেরি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা জানাননি। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, সরকার জানুয়ারির মধ্যেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সময়মতো পাঠ্যবই বিতরণে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা এ উদ্বেগকে ‘ভ্রান্ত ধারণা’ আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে বইয়ের কী সম্পর্ক? নির্বাচন তো বলবে না ‘বই বিতরণ করো না’। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে কিছু প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিধিনিষেধ আসে, কিন্তু শিক্ষাসামগ্রী তার মধ্যে পড়ে না। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, আগের বছরগুলোতেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) দেরিতে বই পৌঁছে দিলেও বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। ড. সালেহউদ্দিন বলেন, শিশুরা জানুয়ারিতেই স্কুলে যায়। এক সপ্তাহ দেরি হলেও ছাত্ররা বই পেয়ে যাবে। আমরাও স্কুলজীবনে দেরিতে বই পেতাম।