কোনোভাবেই থামাতে পারছে না মাটি খেকোদের
তিন ফসলি জমি এখন খালবিলে পরিণত

অস্ত্রের মুখে দুর্বৃত্তরা মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় সাতকানিয়ার ৩ ফসলি বিস্তীর্ণ জমি এখন খাল বিল এ পরিণত হচ্ছে। উচ্চ আদালত ইউএন ও ,ভূমি কর্মকর্তা এমনকি যৌথ বাহিনীর অভিযানও মাটি খেকোদের থামাতে পারছে না। বড় আকৃতির ক্রেন ভেকু সহ আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র ব্যক্তিরা মাটি কাটার জন্য এলাকা ঘেরাও করে রেখেছে। অস্ত্রের মুখে দুটি বাধ তৈরি করেছে। এলাকা বাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি কর্মকর্তাদের নিয়ে বাধ কাটতে যান। সন্ত্রাসী বাধার মুখে বাঁধ না কেটেই ফিরে আসতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাতকানিয়া থানাধীন বিভিন্ন মৌজায় ভূমিধস্যুরা দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক ফসলি জমির মাটি কেটে ইট ভাটায় সরবরাহ করে আসছে। মঙ্গলবার এসিল্যান্ড ও ইউএনও সাতকানিয়া কৃষি জমির মাটি যাতে না কাটাতে পারে সেজন্য ভূমিদস্যুদের নির্মিত বাঁধ কেটে দেওয়ার জন্য আসে এবং বাঁধ কাটা শুরু করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ব্রিক ফিল্ড কমিটির সাধারণ সম্পাদক ভূমিদস্যু ফরিদ উদ্দীন দলবল নিয়ে বাধা দিলে বাঁধ কাটা বন্ধ করে দেয় এবং যতটুকু কেটেছিল সেটি আবার মেরামত করে দেয়। পুনরায় আজ রাত থেকে মাটি কাটার পারমিশন দিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন: ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে মানববন্ধন
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস জানান, সকল আইন ব্যবস্থা নেয়ার পরেও কোনোভাবেই মাটিকাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে তারা অনেক ব্যবস্থা নিয়েছেন বলেন তিনি বিভিন্ন জায়গায় মাটি ফেলে ভরাট করেছেন এবং বর্ষা চলে আসায় বাকি গর্তগুলো ভরাট করতে পারেন নি। তিনি যে তথ্য দিয়েছেন সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। তিনি কোন জায়গায় এক গাড়ি মাটি ফেলে ভরাট করেছেন সেরকম কোন নজির নাই। মূলত তার ছত্রছায়ায় ভূমি দস্যুরা কৃষি জমির মাটি কাটছে। তবে এলাকাবাসী ইউনো মিল্টন বিশ্বাসের বক্তব্য নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন তারা বলেন ঈদ বাটা মালিক সমিতি ভূমিদস্যু সন্ত্রাসী ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোপন যোগাযোগের কারণে মাটিকাটা বন্ধ হচ্ছে না। ঈদ বাটা মালিকরা ও মাটি ব্যবসায়ীরা সমিতির মাধ্যমে প্রশাসনকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে চুপ থাকতে বাধ্য করেছে। এলাকাবাসী মাটিকাটা বন্ধ করে ফসলি জমি রক্ষায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তা চেয়েছেন।
ঠিক এক বছর আগে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছিলেন সাতকানিয়ায় কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি (টপসয়েল) কাটায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে। একই সঙ্গে কেটে নেওয়া মাটি দিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে সেই জমি ভরাটের আদেশও দিয়েছিলেন আদালত। তবে ৯ মাসেও আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং এখন মাটিখেকো সিন্ডিকেট অস্ত্রের মহড়া দিয়ে দিবারাত খননযন্ত্র দিয়ে কৃষিজমির মাটি কাটছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
আরও পড়ুন: ফের ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম রবি শিক্ষার্থীদের
জানা যায়, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের মনেয়াবাদ এলাকার বাসিন্দা আবদুল মুনাফ সাতকানিয়ায় কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি (টপসয়েল) কাটার বিষয়ে ‘ইটভাটা মালিকদের জোরপূর্বক মাটি উত্তোলন, হুমকিতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন ও গ্রামীণ অবকাঠামো’ শিরোনামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ১৯ মার্চ হাইকোর্ট রুল দিয়ে একটি ইটভাটার মাটিকাটার কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেন। আদেশের পরও সংশ্লিষ্ট কৃষিজমির টপসয়েল কাটা অব্যাহত থাকায় বিষয়টি গত বছরের ২২ এপ্রিল বিচারপতি মোস্তাফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর আদালতের নজরে আনেন রিট আবেদনকারীর আইনজীবী। শুনানি নিয়ে আদালত অবস্থান ব্যাখ্যা করতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সাতকানিয়া থানার ওসিকে ২৩ এপ্রিল দুপুরে ভার্চ আলী শুনানি করেন। কৃষিজমি নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না জানিয়ে টপসয়েল কেটে কৃষিজমি চাষাবাদের অনুপযোগী করার ঘটনায় যারা দায়ী তাদের খুঁজে বের করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এ ছাড়া কৃষিজমির উপরিভাগের কাটা মাটি (টপসয়েল) ৩০ দিনের মধ্যে বাইরে থেকে পলিমাটি এনে ভরাট করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সাতকানিয়ায় ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইন থেকে কত দূরে মাটি কাটা হচ্ছে এবং এতে করে রেললাইন হুমকির মুখে পড়ে কিনা তা-ও অনুসন্ধান করে রিপোর্টে উল্লেখ করতে হাইকোর্ট আদেশ দেন।
আদালতের নির্দেশের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত মাটিখেকো সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ভরাট করা হয়নি খননকৃত কৃষিজমিও। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষিজমির মালিক ও সাধারণ কৃষকদের হাইকোর্টের এসব নির্দেশনা প্রশাসন যথাযথভাবে অবহিত করেনি।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক মাসে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ অনুযায়ী ১০ বার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন ইউএনও মিল্টন বিশ্বাস। এতে ১০টি খননযন্ত্র জব্দ করা হয়। অন্যদিকে, এসিল্যান্ড ফারিস্তা করিম সাড়ে ৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় এবং এক ব্যক্তিকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
ইউএনও মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনার পরপর যারা মাটি কেটেছিল তাৎক্ষণিক তাদের দিয়ে অধিকাংশ জলাশয় ভরাট করে দেওয়া হয়েছিল। হঠাৎ বর্ষা চলে আসায় পুরো বিল পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে; ফলে বড় জলাশয়গুলো ভরাট করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে মাটিকাটা বন্ধে দিনরাত অভিযান চলমান রয়েছে। মাটি খেকোদের কোনোমতেই ছাড় দেওয়া হবে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার কেঁওচিয়া, কালিয়াইশ, পশ্চিম ঢেমশা, এওচিয়া, ছদাহা, কাঞ্চনা, নলুয়া, মাদার্শা ও ধর্মপুর ইউনিয়নে নির্বিচারে টপসয়েল কাটা হচ্ছে। কেঁওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহানী ও পাঠানিপুল এলাকা সংলগ্ন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশের তিন ফসলি জমি বিশালাকৃতির জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। এসব কৃষিজমি থেকে ৩০ থেকে ৪০ ফুট গভীর করে মাটি খনন করা হয়েছে। মাটিখেকোরা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে ডাম্পার ট্রাকে কৃষিজমির মাটি পরিবহণ করেন। এতে মহাসড়ক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম (পূর্ব) এর প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা মো.মাহবুবুল করিম বলেন, ‘রেল লাইন এলাকা পরিদর্শন করে দেখা হবে, রেললাইনের কতদূর থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসকসহ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
স্থানীয়রা জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় পদবিধারী এবং নামধারী অনেক নেতা কৃষিজমির টপসয়েল কাটার কাজে জড়িত ছিলেন। তাদের সাথে যুক্ত ছিল অন্য দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরাও। এখন প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এই অপকর্ম চলছে।
ঢেমশা বারি সিকদার পাড়ার কৃষক আবু জাহের সিকদার বলেন, ‘২০১৪ সালে রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে এক টাকাও না দিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমার পাঁচ কানি জমির মাটি কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। তখন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হুমকির কারণে জায়গায় যেতে পারিনি। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরও আগের মতো একই কায়দায় চলছে ফসলি জমির মাটি কাটা। কোন জায়গায় বিচার পাচ্ছি না।’
কেঁওচিয়া ইউনিয়নের আবু সৈয়দ বলেন, ‘রেললাইন সংলগ্ন আমার মালিকানাধীন কৃষিজমির মাটি রাতের অন্ধকারে কেটে নিয়ে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। প্রথম দিকে মহাসড়কের দক্ষিণ পাশের জমির মাটি কেটে জলাশয়ে পরিণত করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো.ইকবাল সরোয়ার বলেন, ‘প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাটি সবচেয়ে মূল্যবান। টপসয়েলের ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চির মধ্যেই জৈব পদার্থ ও অনুজীবের ঘনত্ব সর্বাধিক এবং পৃথিবীর জৈবিক মাটির কার্যকলাপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ অংশে ঘটে থাকে। জমির জৈব উপাদান হ্রাস পেলে তা ফিরিয়ে আনতে ১৮ থেকে ২০ বছর সময় লাগে।’
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফরিদা খানম বলেন, ‘মাটি কাটা বন্ধে ইউএনও ও এসিল্যান্ড দিন-রাত অভিযান চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনেককে শাস্তির আওতায়ও আনা হয়েছে।’ হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কাটা জমি ভরাট করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি।