মুক্তিপণ দিতে না পারায় নির্যাতনে হত্যা শিকার

ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ায় মাফিয়া বন্দিশালায় আটক চুয়াডাঙ্গার প্লাবন

Sanchoy Biswas
সনজিত কর্মকার, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৫:৩৪ অপরাহ্ন, ১৫ মে ২০২৫ | আপডেট: ৫:৫৪ অপরাহ্ন, ১০ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খেজুরতলা গ্রামের তরুণ জুনায়েদ হাসান প্লাবন (১৯) ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দালাল ধরেন। এর আগে কথা হয় পাশের গ্রাম বেলগাছির যুবক লিবিয়া প্রবাসী সাগরের সাথে। তার সাথে চুক্তি ছিলো যেভাবেই হোক বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে পৌঁছে দেবেন। শেষ পর্যন্ত প্লাবনকে ইতালিতে না পাঠিয়ে লিবিয়ায় আটকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে পরিবারের সদস্যরা।

নিহত জুনায়েদ হাসান প্লাবন আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের দমসের আলীর ছেলে।  প্লাবনের মৃত্যুর বিষয়টি তার পরিবারের সদস্যরা বুধবার নিশ্চিত করেছেন।

আরও পড়ুন: ইতিহাসের সবচেয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে: প্রেস সচিব

স্বজন ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, দিনমজুর বাবার স্বপ্ন পূরণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গত ১৬ মাস আগে স্থানীয় দালাল ও লিবিয়া প্রবাসী সাগরের প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশ ছাড়েন প্লাবন। তাকে ঢাকা থেকে সরাসরি দুবাই নেয়া হয়। দুবাই শহরে কয়েক দিন রাখার পর তাকে নেয়া হয় লিবিয়ায়। লিবিয়ার বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পরেই সেখানে মাফিয়ারা (দালাল চক্র) তাকে জিম্মি করে একটি বন্দিশালায় আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায়। চুক্তির ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও পরবর্তীতে আরও ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে প্লাবনের বাবা নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে মুক্তিপণ পরিশোধ করেন। এরপর গত ১ মাস থেকে আবারও প্লাবনের ওপর নির্মমভাবে নির্যাতন করে দালালেরা। দাবি করে আরও ১৬ লাখ টাকা দিলে তার ছেলেকে ইতালিতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। প্লাবনের বাবা দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতন সইতে না পেরে ১৩ মে লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় মারা যান প্লাবন।

বুধবার সকাল ৯ টার দিকে ফোনে প্লাবনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তার পরিবার বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অন্য অভিবাসন প্রত্যাশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের মাধ্যমে ১৩ মে রাতে প্লাবনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানানো হয়। 

আরও পড়ুন: ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে মানববন্ধন

প্লাবনের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য উপজেলার বেলগাছি ইউনিয়নের মালিতাপাড়ার জান্টু মেম্বারের ছেলে লিবিয়া প্রবাসী সাগর। বাংলাদেশ থেকে তরুণদের লিবিয়ায় নিয়ে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে মুক্তিপণের অর্থ আদায় করেন তিনি। পরে মাফিয়াদের নির্যাতনে মৃত্যু হলে ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে লাশ লুকিয়ে ফেলতে বিভিন্ন পাঁয়তারা করে। 

প্লাবনের বাবা দমসের আলী জনা বলেন, দালাল সাগরের মাধ্যমে ছেলেকে ইতালিতে পাঠাইতে চাইছিলাম। ধরা খাওয়ার পরে লিবিয়ার দালাল আমার ছেলেকে বন্দী করে রাখে। এরপর নির্যাতন করে ধাপে ধাপে ২৫ লাখ টাকা নেয়। প্লাবনকে তিন বেলা ঠিকমতো খাইতেও দিত না। আমার পোলাডা অনেক কষ্ট করছে। তবুও ওর স্বপ্ন ছিল ইতালি যাবে। তাই দালালের কথামতো ভিটেমাটি যা ছিল, সব বেচে দিয়ে ছেলেকে ইতালি নিতে দালালের সাথে ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ করি। কিন্তু দালাল আমাগো ভুল বুঝাইছে। আমার ছেলেকে হত্যার জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার চাই।

প্লাবনের বড় বোন স্বপ্না খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুঠোফোনে জানান, ১৬ মাস আমার ভাইকে আটকে রেখে দালাল চক্র টাকার জন্য আমাদের পরিবারকে চাপ দেয়। আমরা মানুষের কাছ থেকে ধার-দেনা করে, চড়া সুদে টাকা দালালের হাতে তুলে দিয়। আমার ভাইকে মারধর করতো আমার আমাদের ভিডিও কলে দেখিয়ে টাকা চাইতো। কয়েক দফায় এই টাকা আদম দালাল সাগর তার আপন চাচাতো ভাই জিম, তার বাবা ঠান্ডু ও মা বেদেনা খাতুনের মাধ্যমে বুঝে নেয়। গত ২০ দিন আগে আমাদের ভিডিও কলে রেখে আমার ভাইকে মারধর করছিল দালাল চক্রের লোকজন। একপর্যায়ে আমার ভাইয়ের মাথায় আঘাত করে তারা। ভিডিও কলে নির্যাতনের ছবি দেখিয়ে আমাদের কাছ আরও টাকা চায়, টাকা দিতে না পারার কথা জানালে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আমাদের গ্রামের জুয়েল নামে আরও একটা ছেলে আছে আমার ভাইয়ের সাথে। দালালরা বুধবার সকালে জুয়েলের স্ত্রীকে ভিডিও কলে জুয়েলকে মারধর ও আমার ভাইয়ের লাশ দেখায়। তারপর আমরা জানতে পারি আমার ভাইকে ওরা মেরে ফেলেছে। এ ঘটনায় দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ মাসুদুর রহমান জানান, লিবিয়ায় প্লাবন হত্যার ব্যাপারে খোজখবর নেয়ার জন্য সরজমিনে তাদের বাড়ীতে যায়। পরিবারের লোকজন হত্যার বিষয়টি বললেও কোন মাধ্যম থেকে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ইতেপূর্বে মানবপাচার আইনে অভিযুক্ত সাগরের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা চলমান রয়েছে।