পরিবেশ অধিদপ্তর ও সাংবাদিক ম্যানেজ করেই চলে ডাইং ফ্যাক্টরিগুলো

Sanchoy Biswas
আশিকুর রহমান, নরসিংদী
প্রকাশিত: ৪:০৮ অপরাহ্ন, ১৭ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৫:২৭ অপরাহ্ন, ২৮ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

জীববৈচিত্র্য যদি বাঁচাতে হয়, মানুষ যদি বাঁচাতে হয়, আমি যদি বাঁচতে চাই, অবশ্যই জীববৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দিতে হবে।

পরিবেশ আইনে আলাদাভাবে শিল্পকারখানায় কাঠ পুড়ানো ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধারা ছাড়া আমি ব্যবস্থা নিতে পারি না এবং কাঠ পুড়ানো ক্ষেত্রে আমাদের কোন ধারাই অপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হয় না — মো. বদরুল হুদা (উপ-পরিচালক), পরিবেশ অধিদপ্তর নরসিংদী।

আরও পড়ুন: কৃষক দল নেতা খন্দকার নাসিরের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারেক রহমানের কাছে মহিলা দলনেত্রীর আবেদন

দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলার গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নরসিংদী। পরিবেশ অধিদপ্তরের চোখের সামনে ব্রাদার্স, ডিএন, সুখী, বাংলাদেশ ডিজিটাল টেক্সটাইল অ্যান্ড ডাইং, বিসমিল্লাহ, ইভা, সুপার ফাইনের মত অসংখ্য ডাইং ফ্যাক্টরিগুলোতে বয়লারে গ্যাসের পরিবর্তে গাছ পুড়ানো এবং কলকারখানার দূষিত বর্জ্যের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের পাশাপাশি মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, শীতলক্ষ্যা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও হাড়িধোয়া নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। এমন পরিস্থিতিতে নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় ভূমিকা রাখার কথা। অথচ এ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঘুমের ভান ধরে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। উৎকোচ নিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড জেনেও নিশ্চুপ থাকছেন। সে সঙ্গে তারা পরিবেশ আইন ও বিধিবহির্ভূত কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দিলেও তা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকছে।

প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত মাধবদীতে ডাইং ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের যেসব ফ্যাক্টরিতে রং ও কেমিকেল ব্যবহৃত হয়, সেইসব ফ্যাক্টরিতে ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও তা মানছেন না প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। আর এসব অনিয়ম করার সুযোগ পাচ্ছেন পরিবেশ অধিদপ্তর, নরসিংদীর একশ্রেণির কর্মকর্তা ও কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিকের কল্যাণে। এমনই চিত্র উঠে আসে মাছরাঙার অনুসন্ধানী “উম্মোচন” সংবাদে।

আরও পড়ুন: ধামরাইয়ে পার্কিং করা যাত্রীবাহী বাসে রহস্যজনক আগুন

সদর উপজেলার ভগীরথপুর (শেখেরচর) বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। আর ব্রহ্মপুত্রের তীরের একপাশে গড়ে উঠেছে দেশের ঐতিহ্যবাহী পাইকারি কাপড়ের বাজার বাবুরহাট। আর অন্যপাশে পরিবেশের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ব্যাঙের ছাতার মতো ব্রাদার্স, ডিএন, সুখী, বাংলাদেশ ডিজিটাল টেক্সটাইল অ্যান্ড ডাইং, বিসমিল্লাহ, ইভা, সুপার ফাইনের মত অসংখ্য ডাইং ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এর এসব কলকারখানা ও ডাইং ফ্যাক্টরির দূষিত বর্জ্য, কেমিকেল মিশ্রিত পানি সরাসরি নিক্ষেপ করা হচ্ছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীতে। আর অন্যদিকে ব্রাদার্স, সুখী ও বিসমিল্লাহ ডাইংয়ে বয়লার চলছে কাঠ পুড়িয়ে।

আর এসব পরিবেশ বহির্ভূত কাজে সহায়তা বা দেখাশোনা সহ স্থানীয় সাংবাদিক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অসৎ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে থাকেন ব্রাদার্স ডাইংয়ের ম্যানেজার ইমরুল সাহেব। তিনি আশপাশের ডাইং ও শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিমাসে চাঁদা তুলে ওইসব ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেন। এ নিয়ে চলতি বছরের জুলাই মাসে পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে ব্রাদার্স ডাইংয়ের ম্যানেজার ইমরুলের সাথে কথা হলে তিনি প্রতিনিধিকে সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকার জন্য অর্থ প্রদানের চেষ্টা করেছিলেন। তার এই অনুরোধ না রেখে প্রতিনিধি গত জুলাইয়ের ৮ তারিখে “নদীর পানি দূষণ রোধে ভূমিকা নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের” বাংলাবাজার পত্রিকায় ও চ্যানেল 21 অনলাইন নিউজ পোর্টালে “নদী দূষণ প্রতিরোধ বাস্তবায়ন না করে উৎকোচে ব্যস্ত নরসিংদীর পরিবেশ অধিদপ্তর” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে পরের দিন অর্থাৎ গত ৯ জুলাই পরিবেশ অধিদপ্তর নরসিংদীর উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান জনতার রোষে অফিস থেকে পালিয়ে যান।

পরে মাছরাঙা টেলিভিশনের একদল অনুসন্ধানী সাংবাদিক ঘটনার সত্যতা পেয়ে গত ১১ নভেম্বর মাছরাঙার “উম্মোচন” নামে একটি প্রতিবেদন তাদের টিভিতে প্রকাশ করেন। এসময় দেখা যায়, ব্রাদার্স ডাইংয়ের ম্যানেজার ইমরুল মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকদের হুমকি ও অর্থের বিনিময়ে সংবাদ প্রকাশ না করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকেন।

পরিবেশ আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে পরিবেশ আইন বহির্ভূত কাজ করলে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা সহ লাইসেন্স বাতিল করার বিধান রয়েছে। আর এসব নিয়ম-নীতি ও শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর নরসিংদী তা না করেই আর্থিক সুবিধা পেয়ে অফিসে বসে ওইসব প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র প্রদান ও নবায়ন করেন। আর এসব ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে হিডেন ইকোনমির আওতায় প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিবেশ দূষণ করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বেশ কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই স্বার্থান্বেষী মহল বিধি-বহির্ভূতভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জনস্রোতি রয়েছে। ফলে পরিবেশ অধিদপ্তর আইন প্রয়োগ বাস্তবায়ন না করে মাসোহারা আদায়ের মাধ্যমে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছেন।

এ বিষয়ে ব্রাদার্স ডাইংয়ের ম্যানেজার ইমরুল বলেন, কি করবো, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান তো চালাতে হবে। কাগজপত্র নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে গেলে ঘোরাঘুরি করতে হয়। তাই কিছু সাংবাদিক ও কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই আমরা প্রতিষ্ঠান চালাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডাইং মালিক ও কর্মচারী জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মনোনীত একজন প্রতিনিধি (দালাল) এর মাধ্যমে বেশ কিছু ডাইংয়ের ইটিপি পরিচালিত হয়। মাসিক চুক্তির মাধ্যমে সেই দালাল নির্ধারণ করে দেন কোন ফ্যাক্টরির ইটিপি কখন, কতক্ষণ চালু থাকবে। যদি কখনো ঢাকা বা বিভাগীয় পর্যায়ের তদন্ত দল আসে, তাহলে দালালের মাধ্যমে আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া হয় মালিক পক্ষকে। যদি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আচমকা পরিদর্শনে কোন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান পরিবেশ দূষণে চিহ্নিত হয়, তাহলে জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দিলেও তা কেবল কাগজে-কলমে থাকছে।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. বদরুল হুদা বলেন, আমি এখানে এসেছি বেশিদিন হয় নাই। আমরা গত মাসে ৩টি শিল্পকারখানায় অনুসন্ধানের মাধ্যমে সেখানে ইটিপি ছিল না, তাদেরকে জরিমানার আওতায় এনেছি। আজকে আবার কয়েকটি শিল্পকারখানার নাম পেলাম। ইটিপি বিহীনভাবে যদি চলে আর আমাদের ইনকোয়ারির মাধ্যমে প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেবো। জীব ও বৈচিত্র্য যদি বাঁচাতে হয়, মানুষ যদি বাঁচাতে হয়, আমি যদি বাঁচতে চাই, অবশ্যই জীববৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। শিল্পকারখানা চলবে, অবশ্যই আইনের মাধ্যমে চলতে হবে। আর কাঠ পুড়ানো নিয়ে এখানে কিছু আইনের ফাঁকফোকর আছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে আলোচনা করেছি। বয়লার চালানোর জন্য তারা সার্টিফিকেট নিয়েছে ঝুট বয়লার হিসেবে। কিন্তু যেভাবেই হোক তারা ঝুট বয়লার হিসেবে কাঠ বা বনাঞ্চলের কাঠ ব্যবহার করছে। আমার কাছে অভিযোগ আছে তারা সেখানে “স” মিলের মত কাঠ চিড়াই করে বয়লারে ব্যবহার করছে। আমরা এ ব্যাপারে বনবিভাগকে অনুরোধ করেছি তারা যেন তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা করে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ইন্ডাস্ট্রিয়াল মনিটরিং গঠন করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমরা প্রতি সপ্তাহে ভিজিট করি। এ ব্যাপারে বনবিভাগ যাতে ব্যবস্থা নেয়, এর জন্য জেলা প্রশাসক নির্দেশ দিয়েছেন। বনবিভাগকে সাথে নিয়ে বনবিভাগের আইনেই কাজ করতে হবে। পরিবেশ আইনে আলাদাভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাঠ পুড়ানো ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধারা ছাড়া আমি ব্যবস্থা নিতে পারি না। কাঠ পুড়ানো ক্ষেত্রে আমাদের কোন ধারাই অপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হয় না।