বছর ঘুরলেই বাড়ি ভাড়া বাড়ার আতঙ্কে ভাড়াটিয়ারা

Any Akter
খালিদ আহমেদ
প্রকাশিত: ১২:৫৯ অপরাহ্ন, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১২:৩৩ পূর্বাহ্ন, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

# ২৫ বছরেও রাজধানীতে বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ

# জানুয়ারি ঘিরে ইচ্ছেমতো বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর তোড়জোড়

আরও পড়ুন: আমাদের ওসমান হাদি: জাতির জন্য নেতা

# ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের তাগিদ

# জানুয়ারি এলেই ভাড়াটিয়ারা উদ্বিগ্ন থাকেন

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী-তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা

ঢাকা এখন সাড়ে তিন কোটির মানুষের এক বিশাল মেগাসিটি, যেখানে অধিকাংশ মানুষই ভাড়া বাসায় বসবাস করে। কিন্তু আয় না বাড়লেও প্রতি বছরই লাগামহীনভাবে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে ক্রমেই অসহনীয় করে তুলছে। আইনের দুর্বল প্রয়োগ, চুক্তির অনিয়ম এবং নজরদারির অভাবে ভাড়াটিয়ারা নীরবে এই চাপ বহন করে চলেছেন। একদিকে বাড়ির মালিকদের খরচ বাড়ার যুক্তি, অন্যদিকে ভাড়াটিয়াদের সীমিত আয়- এই দুইয়ের টানাপোড়েনে রাজধানীর বাসা ভাড়া আজ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের রূপ নিয়েছে। রাজধানীর প্রায় সকল রাস্তায় কিংবা কোন না কোন বাসা-বাড়ির মূল ফটকে প্রতি মাসেই ঝুলতে দেখা যায় টু-লেট সাইনবোর্ড। কর্মজীবী মানুষ যাদের এই শহরে নেই নিজস্ব একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই, তারা দিনের পর দিন একটা ভালো বাসা খুঁজতে ব্যয় করেন দিনের অনেক সময়। কম টাকায় একটা ভালো বাসা পাবার জন্য খুঁজে ফেরেন একাধিক এলাকা। তবুও সাধ্যের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই মিলে না একটি সুন্দর বাসা। আবার অনেক সময় বাসা পছন্দ হলেও ভাড়া বেশি থাকার কারণে নিতে পারেন না অনেকেই। ঢাকার বাইরে থেকে এই শহরে আসা মানুষের বসবাসের জন্য বাসা ভাড়া বাবদ খরচ হয়ে যায় বেতন বা আয়ের অধিকাংশ টাকা। প্রতি বছর জানুয়ারিতে বাসা ভাড়া বাড়ানোকে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে আখ্যা  দেন ভাড়াটিয়ারা। তাই ভাড়াটিয়াদের বছর শুরুই হয় আতঙ্ক ও উদ্বিগ্নতার মধ্যে দিয়ে। সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় নাগরিকদের এই শহরে এসেই ভিড় করতে হচ্ছে। ইচ্ছা থাকলেও নিরাপদ জীবন ও জীবিকার খোঁজে অন্যত্র যাওয়া সম্ভব হয় না। ঢাকা শহরের প্রধান সমস্য হচ্ছে অধিক জনসংখ্যা। দেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মানুষের বসবাসের হিসাবে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকা।

প্রতি বছর নিয়ম করে আয় না বাড়লেও এই শহরে পাল্লা দিয়ে বাড়ে বাড়ি ভাড়া, যা নিয়ে জবাবদিহিতার লেশমাত্র থাকে না মালিকদের। শুধু নীরবেই মাশুল গুনে যায় ভাড়াটিয়ারা। কয়েকজন ভাড়াটিয়া জানান, সাধারণ মানুষের আয় বিবেচনা করা উচিত বাড়ির মালিকদের। আমাদের তো স্যালারি বাড়তেছে না। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। বাড়িওয়ালারা সোজা জানিয়ে দেন, বাড়ি ভাড়া এত টাকা বাড়বে। থাকলে থাকেন, না থাকলে চলে যান।  উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা আব্দুল মালেক জনি। ৭ বছর আগে সাড়ে ৭০০ বর্গফুটের যে ফ্ল্যাটে ভাড়া দিতেন ১৭ হাজার টাকা, তা এখন ২৫ হাজার টাকা। তিনি বলেন, দিন দিন মানুষের চাপ বাড়ছে, চাহিদা খুব বেশি। আমি চলে গেলেও বাড়িওয়ালার অসুবিধা নেই। তিনি আরও বেশি টাকায় ভাড়া দিতে পারবেন। রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডি ও হাতিরঝিল এলাকায় সরেজমিন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১০ বছরে বাসা ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণ। সাধারণ মানুষ বলছে, বাড়ির মালিকরা যদি আইন মানত, তাহলে এভাবে ভাড়া বাড়াতে পারত না। আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। প্রতিটি এলাকার সরকার কর্তৃক একটা নির্দিষ্ট ভাড়া নির্ধারিত থাকা জরুরি।

এ ছাড়া, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য বলছে, ২৫ বছরে ঢাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৪০০ শতাংশ। ক্যাবের ভাষ্য, বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে চুক্তি, সেটি অলিখিত। সে জন্য ভাড়াটিয়ারা এটির ব্যাপারে কোনো প্রতিকার নিতে পারে না। ১৯৯১ সালের যে ভাড়াটিয়া নিরাপত্তা আইন আছে, এটিতে আপডেট করা দরকার এবং বাস্তবায়ন করা দরকার। 

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ অনুযায়ী, দুই বছর অন্তর ভাড়া বাড়ানো যেতে পারে যৌক্তিক কারণে। কিন্তু, এর তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো বাড়ানো হয় ভাড়া। এই সংকট সমাধানে সম্প্রতি বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, যেহেতু নির্দেশিকা সিটি করপোরেশন থেকে আসবে। কেউ যদি ছয় মাস বা এক বছর পর ভাড়া বাড়াতে চায়, তখন তো তাকে কোথাও না কোথাও যেতে হবে ওই ম্যাকানিজম তৈরি করছি। তৈরি করে আমরা আগাব। যাতে এক ধরনের ন্যায্যতা তৈরি হয়। বাসা ভাড়ার ইস্যু গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। বাড়ি ভাড়া নির্ধারণে কেনো নীতিমালা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে গেল ২ ডিসেম্বর রুলও জারি করেছেন হাইকোর্ট। ডিএনসিসি (ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন) উদ্যোগ নিলেও বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে কোনো তৎপরতা নেই ডিএসসিসির (ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশন)।  অথচ কর্মসংস্থানের সিংহভাগ রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হচ্ছেন। প্রতিদিনই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় আসছে মানুষ। আর এসব মানুষের প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। ফলে বাসার চাহিদা থাকায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়িওয়ালারা তাদের মনমতো বাড়িভাড়ার বোঝা চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের কাঁধে। কোথাও যেন জবাবদিহি নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশনগুলোয় বসবাসকারীদের মধ্যে ৭২ শতাংশই ভাড়া বাসায় থাকেন। এসব এলাকায় নিজের বাসায় থাকেন মাত্র ২৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ মানুষ। সিটি করপোরেশনের বাইরে অন্য শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে ভাড়ায় থাকেন ১৮ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যও বলছে, দেশে বাসা ভাড়া বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। 

তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে শহরে বাসা ভাড়া বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। যার মধ্যে গ্রামে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, শহরে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ আর সিটি করপোরেশনে ৭২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। আর দেশে ভাড়া ছাড়াই থাকেন ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ মানুষ। রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি একটি কোম্পানিতে চাকরি করি, বেতন ৪০ হাজার টাকা। দুই সন্তান, স্ত্রীসহ দুই রুমের একটি বাসায় থাকছি। ভাড়া বাবদ মাসে ১৮ হাজার টাকা চলে যায়। ১৫ হাজার টাকা ফ্ল্যাটের ভাড়া। সেইসঙ্গে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ময়লার বিল সবমিলিয়ে আরও ৩ হাজার টাকা। আমার বেতনের ৪০ হাজার টাকার মধ্যে ১৮ হাজার, বলতে গেলে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া পরিশোধেই চলে যাচ্ছে।’ 

আনিসুর বলেন, ‘এরপর আছে সংসারের খরচ, সন্তানদের স্কুলের খরচ, বাড়িতে বাবা-মার ওষুধের জন্য টাকা পাঠানো, আমার আসা-যাওয়ার খরচ। নিত্যপণ্যের দামও যেভাবে বেড়েছে, এতে সংসার টানাটানির মধ্যেই চলে। প্রতি মাসেই ধারদেনা করতে হয়।’ প্রতি বছর রাজধানীতে ৬ লাখ ১২ হাজার মানুষ নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। এক দিনের হিসাবে ১ হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা অন্যতম। কিন্তু আয়তন ও জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটি। এ শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। বনশ্রী এলাকার ভাড়া বাসার বাসিন্দা রোকনুজ্জামান রোকন বলেন, ‘বছর এলেই বাসার মালিকদের ভাড়া বৃদ্ধির পাঁয়তারা চলতে থাকে। দূরে বাসা নিয়েছি সে কারণে হয়তো যাতায়াতের সমস্যা হবে, কিন্তু আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রাখতে এ কষ্ট মেনে নিতেই হয়।’ 

রাজিব চৌধুরী নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘বাসা ভাড়া নীতিমালা যদি থাকে বাস্তবায়ন করুন। ভাড়াটিয়াদের বাঁচান। লাগামহীন বাসা ভাড়া নগরবাসীর জন্য চাপা কষ্টের চেয়েও ভয়ংকর।’ এম এস রাতুল নামে আরেকজন বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক স্কয়ার ফুট হিসাবে সরকারিভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য জোরালো অনুরোধ করছি।’ মধ্যবাড্ডা এলাকায় পাঁচ কাঠা জায়গার ওপর তৈরি সাততলা একটি বাড়ির মালিক রুহুল আমিন। তিনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। রুহুল আমিন বলেন, ‘একজন বাড়ির মালিক সারা জীবনের অর্জিত অর্থ দিয়ে, ধারদেনা, ব্যাংক লোন করে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। এরপর রয়েছে নানা ধরনের খরচ। অনেক বাড়ির মালিক আছে যার একমাত্র আয়ের উৎস বাড়ি ভাড়া। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবন পরিচালনার ব্যয় বেড়ে গেছে। বাসা ভাড়া না বাড়ালে আমরা চলব কীভাবে? যারা চাকরি করেন তাদের বেতন বাড়ে, ইনক্রিমেন্ট হয়। আর যারা ব্যবসা করেন তাদের লাভ হয়, লস হয়, অতিরিক্ত লাভও হয়। কিন্তু যারা বাড়ির মালিক তাদের তো এমন কিছু হয় না। 

অনেকে বছরে একবার ১ হাজার, ২ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া বাড়ান। এটা তো অন্যায় কিছু না। যারা চাকরি করেন তাদের তো ইনক্রিমেন্ট হয়, তাহলে আমরা যারা বাড়ির মালিক তারা কি বছরে বাড়ি ভাড়া বাড়াতে পারি না? এমন যুক্তি থেকে ভেবে দেখবেন বছরে একবার বাড়ি ভাড়া বাড়ানো অন্যায় কিছু না।’ সার্বিক বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, ‘দিন দিন ঢাকায় বাসা ভাড়া বেড়েই চলেছে। বলতে গেলে তারা ভাড়াটিয়াদের ওপর জুলুম করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। ঢাকাসহ সারা দেশে ভাড়াটিয়ারা নিষ্পেষিত। কোনো নিয়মনীতি না মেনে বাড়ির মালিকরা যা ইচ্ছা তাই করছেন, বছরে বছরে নানা অজুহাতে বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন। রাজধানীর লাগামহীন বাসা ভাড়া রোধে প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। ভাড়াটিয়াদের সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনের মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে।’  বাসা ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষের বসবাস ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাজধানীর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি। এজন্য এলাকাভিত্তিক ম্যাপিং করতে হবে। ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আবাসন সমস্যার সমাধান করতে হবে।’