ঢাকার দুই সিটির বেহাল সেবা কার্যক্রম অধিকাংশ সেন্টার বন্ধ-দখল
# ঢাকা দক্ষিণে ৩৭টি ও উত্তরে ১৩টি কেন্দ্র আছে
# উভয় সিটিতে চালু আছে ২২টি কেন্দ্র
আরও পড়ুন: কিল-ঘুষি খেয়েও সন্দেহভাজনকে ধরলেন যুবদল নেতা
# অধিকাংশে চলছে পুনর্নির্মাণ বা সংস্কার কাজ
# জুলাই আন্দোলনে কয়েকটি কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়
আরও পড়ুন: ভবন সংক্রান্ত দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে জনসচেতনতা বৃদ্ধি: রাজউক আয়োজিত সেমিনার অনুষ্ঠিত
# পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম চলছে কয়েকটি কেন্দ্রে
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে কমিউনিটি সেন্টার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে ৫০টি। এগুলোর অর্ধেকের বেশিই অব্যবহৃত। অধিকাংশ কেন্দ্র পুনর্নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য বন্ধ। কাজ চললেও তা শম্বুকগতিতে। কয়েকটি আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কয়েকটি। ফলে সেবাবঞ্চিত নাগরিকরা। এ অবস্থায় নগরবাসী বিয়েসহ বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনে স্বল্প টাকায় সিটি করপোরেশনের কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নেওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছেন না। তাছাড়া যেসব কেন্দ্র চালু আছে, সেগুলোর পরিবেশও তেমন ভালো নয় বলে অভিযোগ নাগরিকদের। ফলে তা ব্যবহারে আগ্রহ কম। বাধ্য হয়ে অধিক ভাড়ায় বেসরকারি কমিউনিটি সেন্টারে যেতে হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৫টি কমিউনিটি সেন্টার ও দুটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি কমিউনিটি সেন্টার ও একটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয়, পরিত্যক্ত, পুনর্নির্মাণ কিংবা সংস্কারের জন্য ২৩টি কমিউনিটি সেন্টার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে সেবাদান কয়েক বছর ধরে বন্ধ।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কমিউনিটি সেন্টার আছে ১৩টি। এর মধ্যে আটটি ব্যবহার হচ্ছে। দুটি কেন্দ্রে সংস্কারকাজ চলছে এবং বাকি তিনটিতে সরকারি সংস্থা দপ্তর খুলে বসেছে। সম্প্রতি তৈরি করেছে ডিএসসিসির সমাজকল্যাণ বিভাগ। ওই বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতন আন্দোলনের সময় সেগুনবাগিচা, পল্টন ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের ফজলুল করিম কমিউনিটি সেন্টারে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। তখন থেকে এগুলো বন্ধ। দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় ধানমন্ডি কমিউনিটি সেন্টার। বাসাবো ও কামরাঙ্গীরচর কমিউনিটি সেন্টার ব্যবহার করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গুলিস্তানে শহীদ মতিউর পার্কের ভেতর কাজী বশির মিলনায়তনে (ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ) সংস্কারকাজ চলছে, তবে ধীরগতিতে। স্থানীয় বিজয়নগরের বাসিন্দা হাবিবুল ইসলাম বলেন, কাজী বশির মিলনায়তনে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বেশি হতো। এটি সংস্কার শুরুর পর রাজনৈতিক দলগুলো রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করছে। এতে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা দরকার।
পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চালু থাকলেও সেখানে তেমন কোনো অনুষ্ঠান হয় না। কারণ, মিলনায়তনের অধিকাংশ চেয়ার ভাঙা। এগুলো মেরামত করা জরুরি। এজন্য করপোরেশনের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে ৪০৮টি নতুন চেয়ার স্থাপন, স্টেজ মেরামত ও লিফট লাগানোর চাহিদা জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আজিমপুর মিনি কমিউনিটি সেন্টার ডিএসসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়-৩ এর রাজস্ব কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। একইভাবে হাজি গণি সরদার কমিউনিটি সেন্টার অঞ্চল-৩, তিলপাপাড়া কমিউনিটি সেন্টার অঞ্চল-২ ও ধলপুর ছিন্নমূল সেন্টারটি অঞ্চল-৬ থেকে ১০-এর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মুগদার আরিফ উদ্দিন কমিউনিটি সেন্টারের দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলা এখন মুগদা থানা। নিচতলায় অনুষ্ঠান করার কথা থাকলেও প্রবেশপথ থানার গাড়ি দিয়ে অধিকাংশ সময় বন্ধ করে রাখা হয়। ফলে এখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ অনুষ্ঠান করতে যান না। নিচতলা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। গণকটুলি সুইপার কলোনিতে একটি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। কিন্তু এটি কলোনির ভেতরে হওয়ায় বাইরের লোকজন কেউ সেখানে অনুষ্ঠান করতে যান না। এখন এটিও প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। সূত্রাপুর সেন্টারটি চালু থাকলেও এর ১৮টি শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) নষ্টের পথে। এগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। ফ্যানগুলোরও একই অবস্থা। এছাড়া কেন্দ্রটির মঞ্চ অনেক উঁচু। উচ্চতা কমাতে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে সমাজকল্যাণ বিভাগ। গেন্ডারিয়া সেন্টারের রং উঠে গেছে। ২২টি এসি ঠিকমতো কাজ করে না। বেসিনগুলোও ভাঙা দেখা গেছে। নবাবগঞ্জ সাত শহীদ সেন্টারের অবস্থা নাজুক। সেখানে দুটি গ্যাসের চুলার বার্নার নষ্ট হয়ে আছে দীর্ঘদিন। যাত্রাবাড়ী কমিউনিটি সেন্টারের রং উঠে গেছে। ভেতরে নেই এসি। টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপোযোগী। রান্নাঘরের পরিবেশও অনেক নোংরা।
ধলপুর কমিউনিটি সেন্টারেও এসি নেই। এর বিভিন্ন অংশের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে। টয়লেটের কমোড, বেসিন, পানির কল ও পাইপ নষ্ট। রোকনপুর কমিউনিটি সেন্টারেরও বেহাল দশা। এটির ভেতরে পর্যাপ্ত লাইট নেই। ফ্যানগুলোও ঠিকমতো চলে না। মতিঝিলে বীর মুক্তিযোদ্ধ সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারটি চালু আছে। তবে এসি নেই। হলরুম, টয়লেট ও মেঝেতে টাইলসের অবস্থা ভালো নয়। জামাল সরদার কমিউনিটি সেন্টারের সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে। এখন এটি বুঝে নেবে ডিএসসিসি। ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন সেন্টারের সংস্কারকাজ চলছে। এর মধ্যে এটিতে সরকারের একটি সংস্থা অবস্থান করছে। নর্থব্রুক হল মিলনায়তন ও মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ সেন্টারের সংস্কারকাজ চলমান। এছাড়া মেয়র মোহাম্মদ হানিফ কমিউনিটি সেন্টার, মৌলভীবাজার কমিউনিটি সেন্টার, মাজেদ সরদার কমিউনিটি সেন্টার, হাজি জুম্মন কমিউনিটি সেন্টার, আলহাজ আবদুর রহিম কমিউনিটি সেন্টার, শায়েস্তা খান কল্যাণ কেন্দ্র, মঈনউদ্দিন চৌধুরী মেমোরিয়াল হল, হাজি হেদায়েতুল ইসলাম কমিউনিটি সেন্টার ও শহীদ নগর কমিউনিটি সেন্টারের পুনর্নির্মাণকাজ চলছে। শহীদ নগরের বাসিন্দা মিরাজুল ইসলাম তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনে ২৮ অক্টোবর লালবাগের একটি বেসরকারি কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করেন। এতে খরচ হয় ৬৫ হাজার টাকা। আলাপকালে মিরাজুল ইসলাম বলেন, শহীদ নগর কমিউনিটি সেন্টারে ১৫-২০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে সুন্দর অনুষ্ঠান করা যেত। সেন্টারের সামনে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। কিন্তু এখন পুনর্নির্মাণের কাজ চলায় তা বন্ধ। বাধ্য হয়ে বেশি টাকা খরচ করে বেসরকারি কমিউনিটি সেন্টারে যেতে হয়েছে। দ্রুত নির্মাণকাজ শেষ করলে মহল্লার লোকজনের উপকার হবে। হাজি গোলাম মোরশেদ কমিউনিটি সেন্টার, ধানমন্ডি ভূতের গলি কমিউনিটি সেন্টার, ইসলামবাগ কমিউনিটি সেন্টার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন কমিউনিটি সেন্টার পুনর্নির্মাণের জন্য ভেঙে ফেলা হয়েছে।
ডিএনসিসির সমাজকল্যাণ বিভাগ সূত্র জানায়, উত্তরা কমিউনিটি সেন্টার, ২ নম্বর ওয়ার্ড কমিউনিটি সেন্টার, ৪ নম্বর ওয়ার্ড কমিউনিটি সেন্টার, ৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিউনিটি সেন্টার, আব্দুল হালিম কমিউনিটি সেন্টার, মহাখালী কমিউনিটি সেন্টার, মোহাম্মদপুরের সূচনা কমিউনিটি সেন্টার ও মগবাজার কমিউনিটি সেন্টার চালু রয়েছে। খিলগাঁও ও রায়েরবাজার কমিউনিটি সেন্টারের সংস্কারকাজ চলমান। আবার বনানী কমিউনিটি সেন্টার, মধুবাগ কমিউনিটি সেন্টার ও ১০ নম্বর ওয়ার্ড কমিউনিটি সেন্টার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করছেন। চালু থাকা কেন্দ্রগুলো নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে ব্যবহার করতে পারছেন নাগরিকরা। তবে নোংরা পরিবেশ থাকায় সিটি করপোরেশনের কমিউনিটি সেন্টারগুলো উচ্চবিত্তদের ব্যবহারের প্রবণতা বেশ কম। সাধারণত মধ্যবিত্ত ও কম আয়ের মানুষ এগুলো ব্যবহার করেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের ক্যাম্পাস ভবনের পশ্চিম পাশে একটি চারতলা ভবনে মহাখালী কমিউনিটি সেন্টার। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভবনটি বেশ পুরোনো এবং জরাজীর্ণ ছিল। দুই বছর আগে তা সংস্কার করা হয়। এখন বাইরে থেকে তা দেখতে বেশ সুন্দর দেখায়। তবে ভেতরে বেসরকারি কমিউনিটি সেন্টারগুলো যেমন চকচক করে, এটির ক্ষেত্রে তেমন দেখা যায় না। ফলে এখানে অনুষ্ঠান আয়োজনে মানুষের আগ্রহ কম। ওয়ারলেস গেটের বাসিন্দা ইকরামুল ইসলাম বলেন, আগের তুলনায় কমিউনিটি সেন্টারটি বেশ আধুনিক কিন্তু তারপরও ভেতর গেলে কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে আসে। টয়লেট ও হাত ধোয়ার বেসিনগুলো কিছুটা অপরিষ্কার থাকে। এ বিষয়গুলো ঠিক করলে সেন্টারের চাহিদা আরও বাড়বে। এ নিয়ে কথা হলে কেন্দ্রটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা মশিউর রহমান বলেন, এখানে সেন্ট্রাল এসি রয়েছে।
সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তারপরও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। মশিউর জানান, এ কমিউনিটি সেন্টারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় দুটি হল রয়েছে। কেউ যদি দিনে অনুষ্ঠান করার জন্য একসঙ্গে দুটি হল নিতে চান তা হলে ৪৫ হাজার ৭৫০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। আর রাতে নিলে ভাড়া পড়বে ৫২ হাজার টাকা। আবার একটি হল নিতে চাইলে দিনে ২১ হাজার ১৫০ টাকা ও রাতে ২৪ হাজার ৬০০ টাকা লাগবে। চাহিদা কেমন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত শীত মৌসুমে তথা নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্রের চাহিদা বেশি থাকে। অন্য সময়ে মাসে দু-চারটির বেশি অনুষ্ঠান হয় না। ডিএনসিসির সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা গৌতম কুমার বিশ্বাস জানান, ডিএনসিসির যে কমিউনিটি সেন্টারগুলো চালু আছে সেগুলো বেশ আধুনিক। সেখানে নাগরিকসেবা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। তারপরও নাগরিকদের সন্তুষ্টির জন্য আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণের কেন্দ্রগুলোর বিষয়ে কথা হলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের বেশি কিছু কমিউনিটি সেন্টারে নাগরিক সেবা চালু আছে। আবার কিছু সেন্টারে সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে। এগুলো ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে। এর বাইরে যেগুলো নির্মাণাধীন, সেগুলোর কাজ দ্রুত শেষ করতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। একইভাবে জরাজীর্ণ সেন্টারগুলো ক্রমান্বয়ে সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করা হবে।





