বাড়ির মালিকসহ এলাকাবাসীর নানা অভিযোগ
গুলশান অফিসারস কোয়াটারের সামনে পলাতক হিট অফিসার স্বামীর সিসাবার

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে সরকারি অফিসার্স কোয়াটারের সামনে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে কথিত হিট অফিসারের জামাতা দীর্ঘদিন ধরে জোর পূর্বক একটি অবৈধ সিসা বার চালু করায় অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। পলাতক হিট অফিসারের ক্ষমতার প্রভাবে এতদিন কেউ কথা বলার সাহস না পেলেও এখন আবাসিক এলাকার মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে অবৈধ এই সিসা লঞ্চটি উচ্ছেদে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে বাড়ির মালিক ও এলাকাবাসী। বাড়ির মালিকের অভিযোগ আবাসিক থাকার কথা বলে ভাড়া নেই অফিসারের স্বামীর বান্ধবী জোরপূর্বক মাদক ব্যবসা চালু করেছে। চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ ও শর্ত ভঙ্গ করায় বাড়ি ছাড়া নোটিশ দিলেও জোরপূর্বক বাড়িতে দখল করে আছে। বাড়ি ছাড়ার কথা বললে ভাড়াটিয়া আফরোজা সুমার নেতৃত্বে দুর্বৃত্ত বাড়ির মালিকের উপরে হামলা করেছে। ক্ষমতার প্রভাবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে সিসা রেস্তোরাঁ করে রেখেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের জামাতা আহমেদ জাওয়াদ রায়হান ওরফে রাবি ডিএনসিসির আলোচিত হিট অফিসার বুশরা আফরিনের স্বামী। এলাকাবাসী করটিয়ার্ড রেস্টুরেন্টের মালিক হিট অফিসারের জামাইয়ের কথা জানলেও ৫ আগস্ট এর পর তার ই বান্ধবী আফরোজা সুমা নিজেই মালিক দাবি করেছে। তবে অবৈধ এই ব্যবসাটি মেয়র আতিকের জামাইয়ের নামেই জোরপূর্বক চালু করেছে। অভিযোগ রয়েছে, আবাসিক হিসেবে ভাড়া চুক্তি করে রেস্তোরাঁ বানানোয় বাড়ি ছাড়তে নোটিশ দেন বাড়ির মালিক মুর্তজা রেজা। গত ২০ সেপ্টেম্বর সেখানে গেলে হুমকি-ধমকি দেন ভাড়াটিয়ার সন্ত্রাসীরা। গত ৩১ অক্টোবর গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ভুক্তভোগী বাড়ির মালিক মুর্তজা রেজা। পুলিশ বলছে, এরই মধ্যে জিডির অনুসন্ধানের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে ১ নিহত, শতাধিক আহত
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গুলশান-১ সার্কেলের ১১২ নম্বর সড়কের ২১/এ প্লটের ৮.৩৭ কাঠা জমির মালিক মুর্তজা রেজা। সিঙ্গাপুর প্রবাসী মুর্তজা রেজা স্থায়ীভাবে বসবাস করায় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে অটোমোবাইল ব্যবসায়ী রায়হান আজাদ টিটোর সঙ্গে আবাসিক ভাড়া চুক্তি করেন। রায়হান আজাদ টিটোর স্ত্রী ছিলেন আফরোজা রায়হান ওরফে আফরোজা বিনতে এনায়েত সোমা। মাসিক এক লাখ টাকা ভাড়ায় এক বছরের জন্য চুক্তি করে উভয় পক্ষ। দ্বিতল বাড়িটিতে কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়া শুধু বসবাসের জন্য ভাড়া দেন বাড়ির মালিক মুর্তজা রেজা। একই সঙ্গে এক মাসের নোটিশে বাড়ি ছাড়ার শর্তও ছিল চুক্তিপত্রে।
আরও পড়ুন: মৌচাকের পার্কিং লটের প্রাইভেটকার থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার
কিন্তু ২০২০ সালে চুক্তি নবায়নের সময় শর্ত ভঙ্গের প্রশ্ন তোলেন মুর্তজা রেজা। আফরোজা রায়হানের সঙ্গে চুক্তির আগে তিনি রেস্তোরাঁ সরিয়ে নেওয়ার মৌখিক শর্ত দেন। ওই সময় সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের মেয়ে আলোচিত চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের স্বামী আহমেদ জাওয়াদ রায়হান ওরফে রাবি শশুরের প্রভাব কাটিয়ে মুর্তজা রেজাকে চুক্তি করতে চাপ দেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে আবাসিক ভাড়া চুক্তি করেন মুর্তজা রেজা।
ওই সময় রেস্তোরাঁ সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেন তাঁরা। কিন্তু রেস্তোরাঁ না সরিয়ে বাড়ির মালিকের অনুপস্থিতিতে জোরপূর্বক আহমেদ জাওয়াদ এর সহায়তায় গড়ে তোলে রেস্টুরেন্ট কাম সিসা লাউঞ্চ। এদিকে দেশে ফিরে বাড়ির মালিক মুর্তজা রেজার বলেন তিনি রেস্তোরাঁর আড়ালে সিসা বার বন্ধে বহুবার চাপ দিলেও বিভিন্নভাবে হেনস্তা শুরু করে জাওয়াদ _ সীমা চক্র।
বাড়ির মালিক মুর্তজা রেজা ও ভাড়াটিয়া আফরোজা রায়হানের মধ্যকার চুক্তিপত্র। চুক্তিপত্রে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন আহমেদ জাওয়াদ রায়হান রাবি। চুক্তিপত্রে জাওয়াদ রায়হানের পিতার নাম ও ঠিকানা যথাক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে মৃত মাহবুবুর রহমান, ফ্ল্যাট বি-৪, ৫, বাড়ি নং : ৩/১২, ব্লক সি, লালমাটিয়া ঢাকা-১২০৭; যা সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে বুশরা আফরিনের স্বামী।
তবে রেস্টুরেন্টের মালিক আফরোজা সুমা দাবি করেন হিট অফিসার বুশরার স্বামী যাওয়াদ তার আত্মীয়। রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি একাই। আত্মীয়তার কারণে যাওয়াদ রেস্টুরেন্টে মাঝে মাঝে আসতো। তিনি এখানে অবৈধ সিসা বার তৈরি করেননি। নিয়ম অনুযায়ী তিনি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করেছেন। বাড়ির মালিকের কাছ থেকে তিনি দুই লাখ টাকায় ভাড়া নিয়েছেন কিন্তু তিনি আমাকে দিয়ে টেক্স পাখি দেওয়ার জন্য ১লাখ টাকার চুক্তি করিয়েছেন। বাড়ির মালিক আমাকে এখনো পর্যন্ত বাড়ি ছাড়ার কোন নোটিশ দেননি উল্টো তিনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন এবং আমার রেস্টুরেন্টে এসে হামলা করায় গ্রাহকরা করতে হচ্ছেন। এ বিষয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। অপরদিকে
ভুক্তভোগী মুর্তজা রেজা বলেন, আমার মা-বাবার মৃত্যুর পর বাড়িটি খালি পড়ে ছিল। আমি একজন বিশ্বাসযোগ্য ভাড়াটিয়া খুঁজছিলাম, যিনি বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণও করবেন। আমি প্রথমে রায়হান আজাদ টিটো এবং পরে তাঁর স্ত্রী আফরোজা রায়হানের সঙ্গে আবাসিক ভাড়া চুক্তি করি। প্রথম বছর তাঁরা ভালোই ছিলেন, মেয়র আতিকুলের জামাতা আহমেদ জাওয়াদ রায়হানের ছত্রচ্ছায়ায় আফরোজা আমার বাড়ি দখল করে নেন। আহমেদ জাওয়াদও এই সিসা বারের অংশীদার বলে আমি জেনেছি।’ বাড়িটির বর্তমান মূল্য একশ কোটি টাকারও বেশি।
তিনি বলেন, আমি ২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিই, কিন্তু তাঁরা বাড়ি না ছেড়ে বিভিন্ন উপায়ে আমাকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। আমাকে দেখে নেবেন বলে শাসাচ্ছেন।
জানা যায়, গত ৩১ অক্টোবর গুলশান থানায় জিডি করেন ভুক্তভোগী মুর্তজা রেজা। জিডিতে বলা হয়, ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভাড়াটিয়াকে আমি বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিই। পাশাপাশি ৩০ জুন ২০২৪ চুক্তি শেষ হওয়ার পরেও আফরোজা রায়হান বাড়িটি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। এরপর গত ২০ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টায় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিতে চাই। কিন্তু আফরোজা রায়হান আমাকে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করেন।
সরেজমিনে দ্য কোর্টইয়ার্ড বাজার রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায় ১১২ নম্বর রোডের দ্বিতল বাড়ির প্রাঙ্গণে সু সজ্জিত রেস্তোরাঁর তরুণ তরুণীদের ভিড় ।খোলা আকাশের নিচে অতিথিদের জন্য সজ্জিত রয়েছে একধিক চেয়ার-টেবিল। রেস্তোরাঁর মূল ফটকের পাশেই পিঠা উৎসবের জন্য একটি স্টল রয়েছে। দ্বিতল ভবনের মূল ফটকে সবুজ কাপড় দিয়ে পৃথক জোন তৈরি করা হয়েছে।
দ্য কোর্টইয়ার্ড বাজারের লবিতে থাকা রেস্তোরাঁয় টেবিলে টেবিলে২২ থেকে ২৩ বছর বয়সী এক যুবক সিসা সেবন করছেন। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী, সিসাকে মাদকদ্রব্যের ‘খ’ শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তরুণ তরুণদের পিতা সেবনের দোয়ায় দুর্গন্ধ আচ্ছন্ন প্রাঙ্গন। পাশেই গণপূর্ত ভবনের সরকারি আবাসিক ভবন ৩। আশপাশের অভিজাত এলাকায় খ বিশিষ্টজনদের বসবাস। মেয়র আতিকের ভয়ে এতদিন কেউ কথা বলতে সাহস পায়নি এই অপকর্মের বিরুদ্ধে।
সরকারি আবাসিক কোয়াটারের বাসিন্দা ও আশপাশের লোকজন জানায় মেয়েরা থেকে জামাই এখানে গড়ে তুলেছে এই অবৈধ বাণিজ্য। নামে রেস্টুরেন্ট হলেও বেশির ভাগ গ্রাহক শুধু সিসা সেবনের জন্যই এসেছে রেস্তোরাঁয়। সিসার পাশাপাশি হালকা খাবারও অর্ডার করছে কেউ কেউ।
কথা হয় রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান জানান, প্রিমিয়াম ও সাধারণ ক্যাটাগরিতে ৩ ফ্লেভারের সিসা সেবনের ব্যবস্থা রয়েছে, যার দাম সর্বনিম্ন এক হাজার ৭০০ এবং সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা। তিনি আরো জানান সরকারের লোকজন এসব জানে।
রেস্তোরাঁটির মূল ভবনে সবুজ কাপড় দিয়ে ঢাকা একটি কক্ষে দেখা যায়, ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক তরুণ-তরুণী সিসা সেবন করছেন। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে কোনো ব্যক্তি সিসা সেবন, বহন, বিক্রি ও সরবরাহ করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।
এলাকাবাসী জানায় দ্য কোর্টইয়ার্ড সরকারি নির্দেশনা অতিক্রম করে এখানে সিসা বার গড়ে তোলে। রাত ২টা পর্যন্ত রেস্তোরাঁর কার্যক্রম চলে। অনেক সময় হৈ-হুল্লোড় হয়। ফলে বাসিন্দাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্। সিসা বারে যারা নিয়মিত যাতায়াত করে তাদের মাদকাসক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবাসিক এলাকায় এই রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠায় উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান জানান সিসা হলো খ শ্রেণীর মাদক। 2% এর বেশি নিকোটিন থাকলে আমরা মাদক হিসাবে গণ্য করি। এ ব্যবসা অবৈধ এর বিরুদ্ধে আমরা অভিযান চালাবো।