আদালতে সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনের জবানবন্দি
পুলিশের কঠোর অবস্থানেও হঠাৎ যে কারণে হাসিনা সরকারের পতন হলো

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের শেষ দুই বছর আইজিপির দায়িত্ব পালন করেন কারাবন্দি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। গত ২৪ মার্চ তিনি ঢাকা মহানগর আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেন। এরপর গত মাসে তিনি আদালতের কাছে দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য আবেদন করেন। আদালতের কাছে দেওয়া তার জবানবন্দির একটি কপি আমাদের হাতে এসেছে।
জবানবন্দির বিস্তারিত:
আরও পড়ুন: ৮ উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সাত্তারের দুর্নীতির অভিযোগ দায়িত্বজ্ঞানহীন: মন্ত্রিপরিষদ সচিব
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ঢাকার মিস কেস নং-০২/২০২৪ এর তদন্তকালে তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আলমগীর, পিপিএম-এর লিখিত ফরওয়ার্ডিংয়ের স্মারক নং-৪৪.০৯.০০০০.০০০.০১২.০০১.২৫-১৪২১, তারিখ-২৪/০১/২০২৫খ্রি. এবং মাননীয় সিএমএম, ঢাকা মহোদয়ের নির্দেশনাক্রমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস রুলস অব প্রসিডিউর এর বিধি ২৪, ২৫(১) মোতাবেক বর্ণিত মামলার আসামির প্রদত্ত জবানবন্দি।
জবানবন্দি গ্রহণকারী: মো. জাকির হোসাইন, অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, সিএমএম কোর্ট, ঢাকা।
আরও পড়ুন: ডাকসু নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আসামি: চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বিপিএম(বার), পিপিএম, বিপি-৬৪৮৯০২০৯৪৬, সাবেক আইজিপি, বাংলাদেশ পুলিশ।
পিতা- মৃত আব্দুল মান্নান চৌধুরী
মাতা- মোসাম্মত জিন্নাতুনেছা চৌধুরী
স্থায়ী ঠিকানা- গ্রাম: শ্রীহাইল, থানা: শাল্লা, জেলা: সুনামগঞ্জ।
বর্তমান ঠিকানা- ইস্কাটন স্বপ্নধারা, ব্লক-এ, ফ্ল্যাট নং-৩০১ (৩য় তলা), রমনা, ঢাকা।
[মহোদয় সিএমএম, ঢাকা মহোদয় থেকে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে বেলা ১২.২৫ ঘটিকার দিকে আসামি সাবেক আইজিপি বাংলাদেশ পুলিশ জনাব চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বিপিএম(বার), পিপিএম, বিপি-৬৪৮৯০২০৯৪৬ কে গ্রহণ করে আমার খাস-কামরায় বিশ্রাম ও চিন্তাভাবনা করার জন্য সময় প্রদান করি।]
[জনাব চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বিপিএম(বার), পিপিএম, বিপি-৬৪৮৯০২০৯৪৬ কে চিন্তাভাবনা করার জন্য ২.৩০ ঘণ্টা সময় দেওয়ার পর জবানবন্দি রেকর্ড শুরু করা হলো।]
জবানবন্দিতে তিনি যা বলেন:
"আমি ১৯৮৬ সালে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে ২০/১২/১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে যোগদান করি। আমি বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশের দায়িত্ব পালনের পর ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি, মহাপরিচালক র্যাব ও পুলিশের আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমাকে দুই বার চুক্তিভিত্তিক আইজিপি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। আমি মোট ২২ মাস আইজিপির দায়িত্ব পালন করি। গত ০৫/০৮/২০২৪খ্রি. তারিখে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারের পতন হলে আমি ঢাকা সেনানিবাসে আশ্রয় গ্রহণ করি। পরবর্তীতে আমাকে বেশকিছু মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। সরকারের ও বাংলাদেশ পুলিশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করায় আমি রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবহিত আছি এবং আমার দায়িত্বের কারণে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় আন্দোলন দমন, পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও মৃত্যু, আহত সহ উক্ত ঘটনা প্রবাহের আমি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি। আমি সারাজীবন সততা, নিষ্ঠা ও আইন অনুসরণের মাধ্যমে আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করি। সরকারের পতন সহ জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে সম্মান প্রদর্শনের অংশ হিসেবে ও বিবেকের তাড়নায় আমি স্বেচ্ছায় এই জবানবন্দি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।"
"আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করিনি। তবে আমার পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। আমার পিতা সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন। আমার সুনাম এবং সরকারের প্রতি আমার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সরকার পুলিশের ডিআইজি, সিআইডির প্রধান সহ র্যাবের মহাপরিচালক হিসাবে আমাকে দায়িত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে পুলিশ বাহিনীতে গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক অফিসারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ দেখা দেওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমার সততা, দক্ষতা ও সিনিয়রিটি বিবেচনাক্রমে আইজিপি হিসাবে আমাকে নিয়োগ প্রদান করেন।"
পাঁচ পৃষ্ঠার জবানবন্দি শেষে সাবেক আইজিপি বলেন, "বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে সরকারের নির্দেশনায় এবং অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসার ও পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং জনগণের ওপর গুলি করাসহ নির্বিচার নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও অসংখ্য মানুষকে আহত ও হত্যা করায় সাবেক পুলিশপ্রধান হিসেবে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। আমি আমার ভূমিকাসহ সার্বিক চিত্র বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে এই জবানবন্দি প্রদান করলাম।"
হাসিনা সরকারের পতন নিয়ে জবানবন্দি:
সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন তার জবানবন্দিতে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগের দিন, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে দুই দফা বৈঠক করেছিলেন।
"৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়। সেখানে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন বাহিনীর প্রধান এবং আমিসহ নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। আন্দোলন পরিস্থিতি এবং তা দমন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায়, আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন। সরকারের পরিবর্তন বা পতন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। এই মিটিংয়ে থাকাবস্থায় পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে ও বিভিন্ন স্থানে সমস্যা দেখা দেয়। পরে বৈঠক মুলতবি হয়।"
দ্বিতীয় বৈঠকের বিষয়ে জবানবন্দিতে বলা হয়, "৪ আগস্ট রাতে হঠাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বৈঠক ডাকেন। গণভবনে রাত ১০টার দিকে বৈঠক হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর বোন শেখ রেহানা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের ডিজি এবং আইজি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। লে. জেনারেল মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে। সেখানে খোলামেলা কথা হয়। এসবি প্রধান মনিরুল ও ডিজিএফআইয়ের ডিজি বাইরে ছিলেন।"
৪ আগস্টের ওই বৈঠকে কীভাবে পরদিনের অর্থাৎ ৫ আগস্টের আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায়, তা নিয়ে কথা হয় জানিয়ে সাবেক আইজিপি জবানবন্দিতে বলেন, "ওই বৈঠকে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠক ৩০-৪৫ মিনিট হয়। বৈঠক শেষে আমরা সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল মুজিব, র্যাবের ডিজি, গোয়েন্দা সংস্থা, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, আমি নিজে ছিলাম। সেখানে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। বৈঠক প্রায় রাত সাড়ে ১২টায় শেষ হয়। বৈঠকে ঢাকা শহর, ঢাকার প্রবেশমুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। পুলিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।"
উত্তরায় জনতার মিছিলে সেনাবাহিনী বাধা দেয়নি:
সাবেক আইজিপি মামুনের জবানবন্দিতে বলা হয়, "৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকার ভেতরে আমাদের (পুলিশ) শক্ত অবস্থান ছিল। ঢাকার প্রবেশমুখে উত্তরা-যাত্রাবাড়ী এলাকায় লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়। আমি তখন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অবস্থান গ্রহণ করি। ডিএমপি কমিশনারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ অফিসাররা ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা নির্দেশনা প্রদান করেন।"
ওই দিনের ঘটনার বিষয়ে জবানবন্দিতে বলা হয়, "বেলা ১১টার দিকে উত্তরা থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকার ভেতরে আসতে শুরু করেন। তখন জানতে পারি যে সেনাবাহিনী বাধা দেয়নি। সেনাবাহিনীর মাঠপর্যায়ের অফিসার ও ফোর্স আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এর ফলে গণভবনমুখী জনস্রোতকে দমন ও আটকানো সম্ভব হয়নি। বেলা একটার দিকে ঢাকার ভেতরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পিএমও (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) থেকে আমাদের বলা হয় মহাখালী এলাকায় জনস্রোত আটকানোর জন্য। আমি ৫ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বুঝতে পারি যে সরকারের পতন হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, এটা আমি এসবির মাধ্যমে জানতে পারি। তিনি ভারত যাবেন কি না, তা জানতে পারিনি। সেনাবাহিনী তা জানায়নি।"
জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, "৫ আগস্ট বিকেল বেলায় জানতে পারি পুলিশ অফিসারদের নেওয়ার জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টারে হেলিকপ্টার আসবে। আমি উক্ত হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাই এবং সেখান থেকে সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে আশ্রয় গ্রহণ করি।"