ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধে আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন

ডাকসু নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Sadek Ali
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ৮:২৮ অপরাহ্ন, ০৯ অগাস্ট ২০২৫ | আপডেট: ৮:২৯ অপরাহ্ন, ০৯ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবাসিক হলে ‘প্রকাশ্য ও গুপ্ত’ রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার যে ঘোষণা দিয়েছে তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে।

আসলে বিশ্ববিদ্যাল  ‘ছাত্র রাজনীতি’ বন্ধের কোনো চেষ্টা হচ্ছে কি-না সেই প্রশ্নও উঠছে।

আরও পড়ুন: ৮ উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সাত্তারের দুর্নীতির অভিযোগ দায়িত্বজ্ঞানহীন: মন্ত্রিপরিষদ সচিব

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে বলেছেন ‘হল পর্যায়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত’ থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যেসব ছাত্র সংগঠন সক্রিয় আছে তাদের দিক থেকে এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। কয়েকটি সংগঠন পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘নিজস্ব দলীয় স্বার্থে’ আন্দোলন উসকে দেওয়ার অভিযোগ করেছে।

আরও পড়ুন: ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে নিবার্চন: সিইসি

গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের একজন নেতা বিবিসি বাংলার কাছে স্বীকারও করেছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে হলেও তাদের অনেকেই এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে।

কেউ বলছেন, ছাত্র রাজনীতির তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এর বিরুদ্ধে সাধারণভাবে ক্ষোভ আছে এবং এখন সেটাকেই ব্যবহারের চেষ্টা আছে কোনো কোনো সংগঠনের মধ্যে।

আবার কেউ বলছেন, ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘গুপ্ত ও প্রকাশ্য’ সংগঠনগুলোর মধ্যকার অঘোষিত প্রতিযোগিতার কারণেই ছাত্র রাজনীতির ইস্যুটিকে সামনে আনা হচ্ছে।

বর্তমান প্রশাসন কর্তৃক গঠিত ডাকসুর আচরণবিধি প্রণয়ন ও সংশোধন বিষয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

তার মতে, ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখেই এখন নানা ইস্যু উঠে আসছে এবং হলে ছাত্ররাজনীতির ইস্যু সামনে এনে কর্তৃপক্ষ ‘কোনো কোনো সংগঠনকে’ বিশেষ সুবিধা দিতে চাইছে বলে মনে করছেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ১৭ই জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রভোস্টরা হলে ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

কিন্তু এখন ডাকসু নির্বাচন এগিয়ে আসায় আবাসিক হলে সাংগঠনিক কার্যক্রম ছাড়া কীভাবে ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনি কার্যক্রম পরিচালনা করবে সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৯ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা।

শুক্রবার যা হয়েছে

বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর কমিটি ঘোষণার পর রাতে তুমুল বিক্ষোভ হয়েছে আবাসিক হলগুলোতে। শুক্রবার সকালে ১৮টি হলের জন্য আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে ছাত্রদল।

এরপর রাতে হলগুলোতে মিছিল বের হতে শুরু করে এবং তাতে ‘ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের’ দাবিটি সামনে উঠে আসে।

একপর্যায়ে রোকেয়া ও শামসুন নাহার হল থেকে ছাত্রীরা বের হয়ে গেলে অন্য হলগুলো থেকেও শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেয়।

রাত প্রায় একটার দিকে রাজু ভাস্কর্য এলাকায় সমাবেশের পর বিক্ষোভকারীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন।

এর ঘণ্টাখানেক পর প্রক্টরকে সাথে নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বাসভবনের সামনে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।

এ সময় তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই হল প্রভোস্টের নেওয়া সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।

যদিও গত বছর আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হল ছাড়ার পর প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের চাপ দিয়ে ওই ঘোষণা সম্বলিত কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিলো।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটেও পরে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়নি বলে জানা গেছে।

তখন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের আবাসিক শিক্ষিকা ছিলেন অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আছে সিন্ডিকেটের। কিন্তু তখন তারা তা করেনি। বরং বিক্ষোভ করে সাদা কাগজে ‘হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’ এমন লিখে এনে তখন চাপ দিয়ে প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিলো।

উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ অবশ্য এও বলেছেন যে “হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রিত থাকবে”।

উপস্থিত বিক্ষোভকারীরা তার প্রতিবাদ করে ‘না না’ বলেন ও ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান।

এ সময় একটি ছাত্র সংগঠনের ‘গুপ্ত কমিটি’র বিষয়ে আপত্তি উঠলে প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ‘প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি’ নিষিদ্ধ থাকবে।

যদিও সক্রিয় কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতারা বলছেন, যারা প্রকাশ্যে কমিটি ঘোষণা করে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা সম্ভব হলেও যারা গোপনে কার্যক্রম চালায় তাদেরকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা হবে- সেটিই এখন প্রশ্ন।

ছাত্ররাজনীতি ও ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ আলোচনায় কেন?

শুক্রবারের আন্দোলনকারীদের একজন রেজওয়ান আহমেদ রিফাত বলছেন, হলের রাজনীতি নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই অনেকের ক্ষোভ আছে এবংএ কারণেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠনের কমিটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

এবারেও আন্দোলনে নানা ধরনের শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত একটা সমাধান বের করা। হলগুলোতে কোন কার্যক্রম কীভাবে চলবে সেটা সবার সাথে কথা বলে তাদেরকেই ঠিক করতে হবে, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

ছাত্রসংগঠনগুলোর কয়েকটি মনে করে, ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘পপুলিস্ট দাবি’ হিসেবে ‘ছাত্র রাজনীতি বন্ধের’ ইস্যুটিকে সামনে আনা হয়েছে।

তবে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।

হলে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ঘোষণাকে ‘অপরিণামদর্শী ও চটকদার’ আখ্যায়িত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমোল্লার বসু বিবিসিকে বলেন, “ক্যাম্পাসে যারা প্রকাশ্য রাজনীতি করে তাদের নেতিবাচকভাবে আর যারা গুপ্ত রাজনীতি করে তাদের ইতিবাচকভাবে দেখানো হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বা ফ্যাকাল্টিতে রাজনীতি না করে আমরা কি সচিবালয়ে গিয়ে রাজনীতি করবো?”

প্রসঙ্গত, গত বছর ৫ই অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ইসলামী ছাত্র শিবিরের কয়েকজন নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি ক্যাম্পাসে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, যাদের কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আন্দোলনের জন্য আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন।

ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলছেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড চালানোর অধিকার এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তো আন্দোলন হয়েছে।

ডাকসু নির্বাচন হবে। সেখানে ছাত্রদলের প্রতি ঈর্ষান্বিত মনোভাব থেকেই কতিপয় রাজনৈতিক দল মব তৈরি করে এ ঘটনা (শুক্রবারের বিক্ষোভ) ঘটিয়েছে। কর্তৃপক্ষকে ব্যাখ্যা দিতে হবে যে হলে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কী হবে। যারা খোলস ছেড়ে বের হতে পারে না তারা এবং লুকিয়ে থাকা ছাত্রলীগ- দুপক্ষই এর পেছনে আছে, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

অন্যদিকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে আন্দোলনের পেছনে শিবিরের ইন্ধন থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার অভিযোগ, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ইন্ধন আছে এর পেছনে।

আমরা কিছু গোপন করছি না। হলে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ আছে, তাই আমরা কমিটি দেইনি। হলের রাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা ভীতিগ্রস্ত। তারা যেভাবে চাইবে আমরা সেভাবেই চলবো, বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

আর গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলছেন, তাদের অনেকে নিজেদের মতো করে ওই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, কিন্তু সাংগঠনিকভাবে তারা অংশ নেননি।

তার মতে, এখন কেউ মব তৈরি করে বলছে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে না, আবার কেউ বলছে হলে থাকবে না।

নানা জায়গায় শিবিরের লোকজনকেই রাজনীতি বন্ধের কথা বলতে শোনা যায়। আবার পরে সেখানে তাদের কমিটিতেও দেখা যায়, বলেন তিনি।

সামনে ডাকসু নির্বাচন। সবাই পপুলিস্ট ভূমিকা নিতে চাইছে। এই সুযোগ যারা পরিচয় লুকিয়ে রাজনীতি করে তারা পেছন থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. কাদের।

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন, ডাকসুতে দল হিসেবে নির্বাচন না হলেও ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর বিভিন্ন প্যানেল সমর্থন দেওয়ার রেওয়াজ আছে। ফলে হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালায় না এমন কোনো কোনো সংগঠনের জন্য সুবিধা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

আমরা উপাচার্যকে বলেছি নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। কিন্তু তাদের কারও প্রতি পক্ষপাতমূলক মনে হচ্ছে। আবার ডাকসুর পরেই জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এসব কারণে আমার ধারণা ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখেই এ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

অন্যদিকে জোবাইদা নাসরীনের মত হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাধারণ ছাত্রদের’ পরিচয়টাও অধিকাংশ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।

এখানে রাজনৈতিক উপাদান আছে। কারণ দেখুন, এই ব্যানারটিকে কিন্তু অন্য ইস্যুতে কথা বলতে দেখা যায় না। বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে এটি সক্রিয় হয়। আর হলে ছাত্ররাজনীতি বিষয়ে একক সিদ্ধান্তের এখতিয়ার তো ভিসির নেই। কেবল সিন্ডিকেটে এটি হতে পারে। সেখানে তো এ নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি, বলছিলেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবশ্য বলেছে, তারা সবার সাথে আলোচনা করেই এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান শুক্রবার রাতে শিক্ষার্থীদের বলেছেন, ডাকসুর ব্যাপারে তাদের যখন প্যানেল হবে, তারা কীভাবে কাজ করবে, হলে তো তাদের কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে ঐক্যমত্য দরকার।

তাদেরকে তো পরামর্শ দিতে হবে আমাদের। এই বিষয়গুলো তো তোমাদের বলতে হবে পরিষ্কার। আচরণবিধি অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে এই ব্যাপারে ঐক্যমত্য লাগবে, বলেন তিনি।