নির্বাচন বানচালে সক্রিয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা
- অফসিল ঘোষণার প্রার্থীর উপর হামলা, বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনী অফিসে হামলা
- সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে-মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান
- আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীদের দমনের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট: ফেজ-২’ চালু করা হবে- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করতে দেশে ভয়াবহ নাশকতা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কার কথা গোয়েন্দারা গত অক্টোবরেই সরকারকে জানিয়েছে।ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয় দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, স্থাপনা, কেপিআই এলাকা, গার্মেন্ট শিল্প এমনকি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ব্যাপকভাবে নাশকতাসহ বিভিন্ন ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখে বাংলাদেশ পড়তে পারে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি একটি প্রতিবেশী দেশও জড়িত বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আর এই তথ্যের ভিত্তিতেই গত ২৯ অক্টোবর ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যমুনায় অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হবে। নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর থেকে, বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে।
এই আশঙ্কারই প্রকাশ ঘটলো গত ১২ ডিসেম্বর খোদ রাজধানীতে। ওই দিন দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে ফিল্মি স্টাইলে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। রাজধানীতে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া দুটি জেলায় নির্বাচন অফিসেও হামলা ও আগুন দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত মাসে অর্থৎ ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সন্ত্রাসী ঘটনায় প্রার্থীদের স্বাভাবিক প্রচার-প্রচারণায় ব্যাঘাত ঘটবে, আতঙ্কে থাকবেন ভোটাররা।
আরও পড়ুন: এক আসনে একাধিক প্রার্থী দিতে পারবে রাজনৈতিক দল
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, তফসিল ঘোষণার পর পরই অর্থাৎ নির্বাচনের শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক না রাখতে পারলে দিনে দিনে নির্বাচনী মাঠে তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়তে পারে। এজন্য আগাম গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও বেশি করে তৎপর থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অবশ্যই নির্বাচনের পরিবেশের ওপর বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। সেই ধরনের তৎপরতা আমরা দেখতে পাইনি। অস্ত্র উদ্ধারে বড় ধরনের অপারেশন আমরা দেখতে পাইনি। মুখে দু-একটা কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কার্যত তেমন কোনো কিছু দৃশ্যমান হয়নি। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে, তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। গোয়েন্দা নজরদারি ও তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। এসব কিছুতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় ভূমিকায় থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: তারেক রহমান দেশে ফেরার খবরে উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা
এদিকে গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.)মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, জাতীয় নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীদের দমনের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট: ফেজ-২’ চালু করা হবে। তিনি বলেন, লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলমান। এটি আরও জোরদার ও বেগবান করার জন্য এবং ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীদের দমনের উদ্দেশ্যে কোর কমিটি ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট: ফেজ-২’ অবিলম্বে চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া অপরাধ কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভালোমন্দ’ নির্ধারক প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী রয়েছে। খোদ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। ক্ষুদ্র সংঘাতেও আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া দেখা গেছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকতে হয়। বর্তমানে খুব একটা খারাপ নেই, আবার খুব ভালোও নেই। এমনটা থাকলেও নির্বাচন পার হয়ে যাবে হয়তো। যাতে অবনতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি বলেন, তফসিলের পর একজন প্রার্থীর ওপর এমন ঘটনা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। যদি জড়িতদের বিরুদ্ধে ভালো অ্যাকশন না নেওয়া হয়, তাহলে কিছু লোক উৎসাহিত হবে।
গত এক মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই সময়ের মধ্যে সারা দেশে আলোচিত অন্তত ২০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১২টি হত্যাকাণ্ডে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও অন্তত চারটি ঘটনায় গুলিবর্ষণ হয়। এর আগে ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে নির্বাচনী জনসংযোগের সময় বিএনপি প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হন। তবে এখনো ওই ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার হয়নি। এর মধ্যেই হাদির ওপর গুলির ঘটনা ঘটল।এ ছাড়াও গত ৫ নভেম্বর টেকনাফে সেতুর নিচ থেকে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৬ নভেম্বর খুলনায় এক প্রবাসীকে ৮ রাউন্ড গুলিতে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ১০ নভেম্বর পুরান ঢাকার আদালত থেকে হাজিরা দিয়ে বের হওয়ার পর সন্ত্রাসীরা ফিল্মি স্টাইলে গুলি করে তারিক সাইফ মামুন নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। মামুনও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিল।
এদিকে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চিত্র বিশ্লেষণে পুলিশ সদর দপ্তর প্রতি মাসে এবং প্রতি তিন মাস পরপর অপরাধ পর্যালোচনা সভা করে থাকে। এসব সভার মধ্যে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনায় সাধারণত দুই মাসে দেশে সংঘটিত অপরাধের পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা হয় এবং পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নানা কৌশলসহ নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত অক্টোবর মাসের অপরাধ পর্যালোচনা সভাটি গত ২৩ নভেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে দেশে সংঘটিত খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি, অপহরণ, দাঙ্গা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার সংক্রান্ত মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তাতে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসের চেয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রেই অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে।পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে সেপ্টেম্বর মাসে ২৯৭টি খুনের মামলা হয়। তবে গত অক্টোবরে ৩২০টি খুনের মামলা হয়। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে ২৩টি খুনের মামলা বেশি হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, গত বছর গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ স্থাপনা থেকে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়ে যায়। অবৈধ এসব অস্ত্র উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চললেও পুরোপুরি সফলতা আসেনি। এখনো বিভিন্ন ধরনের ১ হাজার ৩৪০টি অস্ত্র ও ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৮০টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা যায়নি। এসব অস্ত্র-গুলিও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে বড় চিন্তার কারণ।





