পরিণত হচ্ছে দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রে

বদলে যাওয়া আগারগাঁও: ভোগান্তির শহরে প্রশান্তির রাস্তা, মেট্রোরেলে আরও বেড়েছে গুরুত্ব

Shakil
মোয়াজ্জেম হোসেন
প্রকাশিত: ২:৫৯ অপরাহ্ন, ১৭ অগাস্ট ২০২৩ | আপডেট: ১২:৩০ অপরাহ্ন, ১৭ অগাস্ট ২০২৩
সংগৃহীত
সংগৃহীত

পুরো এলাকাজুড়েই ছিল বস্তি। ছিল নালা ডোবা আর ধানক্ষেত। সন্ধ্যার পরে ভয়ে কেউ রাস্তায় বের হতেন না। এখন সেখানে দৃষ্টিনন্দন সড়ক আর অপরূপ নির্মাণশৈলীর ভবন। বলছিলাম, রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার কথা। গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে এলাকাটিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। পরিণত হয়েছে দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রে।

ব্যস্ত শহর রাজধানীর উত্তর মধ্যভাগে চোখ জুড়ে যাওয়া ছোট্ট একটি এলাকা। শের-ই বাংলা নগর, তালতলা, শ্যামলী এবং মিরপুর। জনবহুল এই চারটি এলাকার ঠিক মাঝখানের জায়গাটার নামই আগারগাঁও। এক সময়ের নালা ডোবা আর ভূতুরে এই জনপদ এখন দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র। ভোগান্তির শহরে প্রশান্তির রাস্তা এখানে। অথচ, একটা সময় ছিল- এই সড়কগুলোতে ইঞ্জিনচালিত গাড়ি তো দূরের কথা রিক্সাই ঠিকমতে চলতো না।

আরও পড়ুন: প্রথমবার বাংলাদেশে তৈরি হবে রপ্তানীমুখী ড্রোন, জমি নিতে বেপজার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন

আগারগাঁওয়ের অত্যাধুনিক রাস্তাগুলো পুরো এলাকার চেহারা একেবারে পাল্টে দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি সড়কই এখানে ৪ থেকে ৬ লেন বিশিষ্ট। আধুনিক বিশ্বের আধুনিক শহরের মতো ঢাকা মহানগরীতে প্রথম দেড়শ' ফুট চওড়া রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে এখানে। সঙ্গে আছে প্রশস্ত ফুটপাত, সাইকেল লেন, রোডসাইড গাড়ি পার্কিংয়ের মতো সুবিধা। 

পাঁচটি প্যাকেজে আগারগাঁও এলাকার রাস্তা, ফুটপাত ও ড্রেন নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত নির্মিত নতুন এ দৃষ্টিনন্দন সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা। যার দৈর্ঘ্য ৯৩৬ ফুট ও প্রশস্ত ১৫০ ফুট।

আরও পড়ুন: মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে যা হচ্ছে

পাসপোর্ট, সমাজসেবা, পরিসংখ্যান, প্রত্নতত্ত্ব ও আবহাওয়া অধিদপ্তর। এলজিআরডি, বন ভবন, সিউকিউরিট এক্সচেঞ্জ কমিশন, সরকারি মহিলা পলিটেকনিক, সরকারি সংগীত কলেজ, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, বিজ্ঞান জাদুঘর, পরমানু শক্তি কমিশন, বেতার ভবন, জাতীয় গ্রন্থাগার, ও আর্কাইভ কি নেই এখানে! 

আগারগাঁও এলাকায় পরিবর্তন শুরু হয় ২০০৯ সালের পর থেকে। ধীরে ধীরে গড়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। অনেকগুলো বিশেষায়িত হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিনোদন, আবাসনসহ নানা কারণে এই এলাকা থেকে মিরপুর পর্যন্ত বসবাসের চাহিদাও বাড়ছে। মেট্রোরেল চালু হওয়ায় আগারগাঁওয়ের বেড়েছে গুরুত্ব।

শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে বৃদ্ধ বয়সে পড়েছেন লোকমান আলী। সবমিলিয়ে প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন- এই আগারগাঁও এলাকায়। তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠা এক সময়ের আগারগাঁওয়ের গল্পটা এমন যে- সন্ধ্যার পরেই আতঙ্কে-ভয়ে এই এলাকার রাস্তায় বের হতেন না কেউ।

তিনি বলেন, এই এলাকায় আগে নদী ছিল, ডোবা ছিল, খাল ছিল, কল্যাণপুর পর্যন্ত নৌকা আসতো। আমি যখন এই এলাকায় আসি তখন এসব এলাকার বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গল ছিল এবং শিয়াল বসবাস করতো। সন্ধার পরে মানুষ ভয়ে বের হতো না। এখন এই এলাকার এতো পরিবর্তন হয়েছে যে কল্পনার বাইরে। 

এক সময়ের বস্তিঘেরা এই এলাকাটিতে এখন বিলাসবহুল সরকারি ভবন। এরইমধ্যে প্রায় ৩০টি ভবনের কাজ শেষ। আরও বেশকিছু ভবনের কাজ চলছে। নির্বাচন কমিশনের পাশেই ১৪ তলা এই ডাক ভবনটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ৯২ কোটি টাকা। তার পাশেই কোস্টগার্ডের সদর দপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর।

ডাক ভবনের ঠিক পেছনে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্স। ১৩ তলা ভবনটির নির্মাণে খরচ হয় ২২২ কোটি টাকা। দেশের বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম করার পাশাপাশি সচিবালয় থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে ভবনটি করা হয়। 

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি'র নিজস্ব ১২ তলা ভবন নির্মিত হয়েছে আগারগাঁওয়ে। তার পাশেই বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিডা নিজস্ব ১৪ তলা ভবন। এই ভবনেই প্রক্রিয়াধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেজা এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অফিসও মহাখালী থেকে চলে এসে আগারগাঁওয়ে এখন দৃষ্টিনন্দন পর্যটন ভবন।

গনপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, গ্রীন বিল্ডিংয়ের যে সমস্ত ধারনা এখানে কিন্তু সবগুলো ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। এখানকার স্থাপত্য শৈলী যেমন সুন্দর তেমনি এনার্জি সাশ্রয়ের সকল ফিচার এখানে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছে। 

একদিন স্বাধীনতার সূর্য্ উদিত হয়েছিল বাংলাদেশের আকাশে, সে উদিত সূর্যের পেছনে রণাঙ্গনের কত স্মৃতি। তারই সাক্ষী হয়ে আগারাগাঁওয়ে অপরূপ নির্মাশৈলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। তার পাশ দিয়ে সামান্য একটু এগোলেই স্খলবন্দর কর্তৃপক্ষ'র ১৪ তল ভবন। যা নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। ঠিক পাশের সাড়ে ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১৫ তলা ভবনটি তথ্য কমিশনের প্রধান কার্যালয়। এখানেই নির্মিত হচ্ছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি ভবনসহ বেশ কয়েকটি নতুন স্থাপনা। 

আগারগাঁওয়ে ৪১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জাতীয় রাজস্ব ভবনে এরইমধ্যে দাপ্তরিক কাজ শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে এই এলাকায় নির্মিত হবে রাজস্ব ভবন-২।

গনপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, রাজস্ব ভবন এটা হতে কিন্তু অনেক সময় লেগেছে। সময় বাাড়ানের কালচার থেকে কিন্তু আমরা বের হয়ে আসতে চাচ্ছি। অধিকাংশ ভবনগুলো যখন হয়ে যাবে তখন এটা আরো পূর্নতা লাভ করবে, আরো সুন্দর লাগবে। 

পশ্চিম আগারগাঁও বাজার, যেটিকে মানুষ বিএনপি বাজার হিসেবে চেনে, এটি চলে যাচ্ছে পাশের বহুতল ভবন মমতা টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্সে। সরকার এই বাজার কমিটিকে এক একর জায়গা দিয়েছে। কমিটি ৮১ কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করছে। বাজার চলে গেলে ঢাকা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কার্যালয় পুরান ঢাকা থেকে এখানে চলে আসবে। সংসদ সচিবালয় কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত আবাসিক এলাকাও এখানে।

চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট থেকে শুরু করে নিউরোসায়েন্স। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি এই এলাকায় নির্মিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য পরীক্ষাগার।

আগারগাও এলাকায় যত গুরুত্বপূর্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার মধ্যে অন্যতম ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টার, এটিকে বলা হয় দেশের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন পরীক্ষাগার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সহ দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ল্যাবেও যদি কোন স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে জটিলতা হয় তাহলে সেই পরীক্ষাকে এখানে পুনরায় পরিক্ষা করা হয় এবং এখানের ফলাফলকে নির্ভুল বলে ধরে নেওয়া হয়। 

ইউনিসেফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং আইএলওসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার দপ্তরও আগারগাঁও এলাকায়। শুক্র এবং শনিবার, সপ্তাহে দুইদিন- নির্বাচন কমিশনের সামনে থেকে সরকারি কর্ম কমিশনের ভবন পর্যন্ত জমজমাট থাকে হলিডে মার্কেট।

অস্থায়ী খাবার দোকানে এই সড়কটি যেনো ছোট্ট একটি রেস্টুরেন্ট পাড়া। যেখানে সন্ধ্যার পর মানুষ আসতেই ভয় পেতো, সেখানে এখন গল্প আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। অনেকের রুটি-রুজি। রাত যত গভীর হয়, আস্তে আস্তে নীরব হতে থাকে আগারগাঁও এলাকা। তবুও পাখির চোখে দেখলে লিখতে ইচ্ছে করবে বদলে যাওয়া এক আগারগাঁওয়ের গল্প।