গভীর সমুদ্রে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, আনন্দে জেলেরা

Shakil
বাংলাবাজার পত্রিকা রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১:০৯ অপরাহ্ন, ১৯ অগাস্ট ২০২৩ | আপডেট: ৯:২২ পূর্বাহ্ন, ১৯ অগাস্ট ২০২৩
(no caption)
(no caption)

দীর্ঘ সময় পর কাঙ্ক্ষিত ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরছেন গভীর সমুদ্রের জেলেরা। দীর্ঘদিন পর ইলিশের দেখা পেয়ে খুশি জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ইলিশের সরবরাহ বাড়ায় সরগরম হয়ে উঠেছে উপকূল অঞ্চলের মৎস্য আড়তগুলো। তবে সরবরাহের তুলনায় বাঙালির অতিপ্রিয় এ মাছের দাম অনেকটাই বেশি। তাই মৌসুম এসে গেলেও মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের পাতে ওঠেনি বড় সাইজের মাছের পেটি। তবে তাদের অনেকেই অপেক্ষা করছেন দাম কমার। কিছুটা কমলেই সুস্বাদু মাছের ঘ্রাণ আস্বাদন করবেন তারা। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কক্সবাজার : বঙ্গোপসাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। গত বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত শত শত ট্রলারভর্তি ইলিশগুলো ঝুড়িতে করে এনে কক্সবাজার শহরের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারিঘাট মৎস্য আড়তে ফেলেন শ্রমিকরা। এরপরই আড়তদারদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। পাইকারি ক্রেতারা দরদাম শেষে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য কার্টনে ভরা শুরু করেন ইলিশ। ট্রাক ও অন্যান্য গণপরিবহনের ছাদে করে সাগরের এসব ইলিশ চলে যাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

আরও পড়ুন: সাদা পাথর রক্ষায় প্রশাসনের ৫ দফা সিদ্ধান্ত

গত মাসে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর ফিশিং বোটগুলো সাগরে যায়। তখন তেমন একটা মাছ ধরা পড়েনি। এরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে আবার সাগরে যায় বোটগুলো। গত কয়েক দিন থেকে বোটগুলো ইলিশ নিয়ে পাড়ে আসছে। এ ছাড়া বাঁকখালী নদীর মোহনা দিয়ে প্রতিদিনই বড় বড় ট্রলার যাচ্ছে সাগরে মাছ শিকারে। আবার কিছু ট্রলার ফিরছে কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে। প্রতিটি ট্রলারে জেলেদের মুখে হাসি। জেলেরা বলছেন, সাগরে জাল ফেলতেই ধরা পড়ছে ইলিশ। তারা এতে অনেক খুশি। একেকটা মাছের ওজন ৬০০ গ্রাম থেকে ১ কেজির ওপরে।

স্বাভাবিকভাবেই কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পন্টুন মৎস্য ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও জেলেদের হাঁকডাকে সরগরম। দীর্ঘদিন পর পন্টুনে ইলিশ দেখে ব্যবসায়ীদের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। তবে দাম বাড়তি বলেও জানান তারা। ব্যবসায়ীরা বলেন, মাছের সরবরাহ ভালো। তবে বড় মাছের দাম অনেক। এক কেজির বেশি (১১০০-১২০০ গ্রাম) ওজনের ইলিশ ১০০ পিস বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকায়। মাঝারি আকারের ইলিশ (৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম) বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। এ ছাড়া বড় আকারের ইলিশের কেজি ১৮০০ টাকা, মাঝারি ১০০০ থেকে ১৪০০ টাকা ও ছোট (২০০ গ্রাম) ৮০০ টাকা।

আরও পড়ুন: ‎পাবনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহার

কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান জানান, ২০২২ সালে কক্সবাজারে ইলিশ আহরণ করা হয়েছিল ৪০ হাজার ৩৫৪ মেট্রিকটন। এবার ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার মেট্রিকটন। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে সাগরে পানি বৃদ্ধি পেলে তখন বেশি ইলিশ ধরা পড়ে জেলেদের জালে। এবার দুই মাস বন্ধ থাকায় মাছের প্রজননও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ হিসাবে প্রতিদিনই পুরো জেলায় প্রায় ৫ মেট্রিকটন ইলিশ ধরা পড়ার কথা। তিনি আরও জানান, সাগর কিছুটা শান্ত হওয়ায় জেলেরা ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ ধরতে ট্রলার নিয়ে গভীর সাগরে রয়েছেন। ধীরে ধীরে বিপুল পরিমাণ ইলিশও ধরা পড়ছে। আশা করছি এতে জেলেদের অভাব দূর হবে।

কক্সবাজার বোট মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ নুরুল ইসলাম চিশতি বলেন, সাগরে যেভাবে মাছ ধরা পড়ছে তাতে এ বছর ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। উল্লেখ্য, কক্সবাজারে লক্ষাধিক জেলে থাকলেও নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৩ হাজারের কিছুটা বেশি। আর নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা সাড়ে ৫ হাজারের বেশি।

পটুয়াখালী: পটুয়াখালীর বড় দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আলীপুর ও মহিপুর ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন আড়তে স্থানীয় ছাড়াও চট্টগ্রাম, ভোলা, বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার থেকে অনেক ট্রলার ইলিশ বিক্রি করতে এসেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ায় সরগরম পুরো মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। বিভিন্ন সাইজের ইলিশের ক্রয়-বিক্রয় এবং হাঁকডাকে ব্যস্ত মৎস্য ব্যবসায়ীরা।

দীর্ঘ ৬৫ দিনের অবরোধ শেষে সমুদ্রে যাওয়ার সাতদিনের মধ্যে দুইবার বৈরী আবহাওয়ার প্রভাবে ফিরে আসায় সংকটে পড়েন জেলেরা। তবে এবার সমুদ্রে নামার পর ইলিশের দেখা পেয়ে সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছেন তারা। ইলিশের দেখা পেয়ে তারা যেমন খুশি, তেমনই খুশি দামেও। তবে অতিরিক্ত দামে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মাঝে মাঝে লোকসানে পড়ছেন।

আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছ বিক্রি করতে আসা এফবি মারুফ ট্রলারের মাঝি বেল্লাল হোসেন বলেন, দশদিন আগে সাগরে মাছ ধরতে গেছিলাম। প্রথম চার দিন জাল টেনে কোনো মাছ পাইনি। পরে অল্প অল্প মাছ পেতে থাকি। গতকাল পর্যন্ত মোটামুটি ভালো মাছ পেয়েছি যা গত এক বছরেও পাইনি। আজ মাছ নিয়ে আলিপুর মৎস্য বন্দরে বিক্রি করতে এসেছি। যা মাছ পেয়েছি তার দাম ১০ লাখ টাকার ওপরে হবে।

তিনি আরও বলেন, গত ২ মাসে ৩ বার সাগরে গিয়ে ১৫ লাখ টাকা লোকসানে পড়েছি। এরমধ্যে আবহাওয়া খারাপ থাকায় কয়েকবার তীরে ফিরতে হয়েছে। ১০ দিন আগে চরফ্যাশন থেকে মাছ শিকারে নেমে আজ মাছ বিক্রি করতে এখানে এসেছি। আবার এখান থেকে ১৫ দিনের বাজার নিয়ে সাগরে যাবো। মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবো। এভাবে যদি মাছ আবার পাই তাহলে ঋণ পরিশোধ করে সংসারে খরচ করতে পারবো।

আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের মোল্লা ফিসের পরিচালক এজাজ মোল্লা বলেন, গভীর সমুদ্রের জেলেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ নিয়ে আসছে এবং ভালো দামও পাচ্ছে। আজ জাটকার মণ ২১ হাজার টাকা, ৬০০-৭০০ গ্রামের ইলিশ ২৮ হাজার, ৮০০-৯০০ গ্রামের ইলিশ ৩৬ হাজার এবং ১ কেজির উপরের ইলিশ ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। তবে এই দামে জেলেরা খুশি থাকলেও পাইকারি ক্রেতারা প্রায়ই লোকসান গুনছেন।

চাঁদপুর : চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনায় নদীতে জেলেরা কাক্সিক্ষত ইলিশ না পেলেও দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। আর সেই ইলিশ ট্রলার ও ট্রাকে চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছ ঘাটে নিয়ে আসা হচ্ছে। ইলিশের সরবরাহ বাড়ায় সরগরম মাছ ঘাট। কর্মব্যস্ততা বেড়েছে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের মধ্যে।

এদিকে শুক্রবার সারা দিন চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছ ঘাটে ৫০০-৬০০ মণ ইলিশ সরবরাহ হয়েছে। এসব ইলিশ ঘাটে এনে স্তূপ করে রাখেন ব্যবসায়ীরা। তবে কিছুটা সরবরাহ বাড়লেও দাম এখনও নাগালের বাইরে। বিকালে বড় স্টেশন মাছ ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে মাছ ধরার ৩টি বড় ট্রলার মাছ ঘাটে এসেছে। একটিতে ৭৫ মণ, একটিতে ৫০ মণ ও আরেকটিতে ২৫ মণ ইলিশসহ ১৫০ মণ ইলিশ রয়েছে।

হাতিয়া থেকে এফবি মা-বাবা ফিশিং বোটের পরিচালক মির্জা আরিফ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের ট্রলারে তেমন ইলিশ পাইনি। তবে এখন জালে ইলিশ ধরা পড়ছে। আমাদের ট্রলারে ৭৫ মণ ইলিশ রয়েছে। দাম ভালো পেলে লাভবান হব। দক্ষিণাঞ্চলের হাতিয়া, চরফ্যাশন, সন্দ্বীপ, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থানে এখন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এখানে দাম বেশি থাকায় অনেকে চাঁদপুর মাছ ঘাটে ইলিশ নিয়ে আসেন।

ইলিশ ট্রলারের মাঝি নূর আহমেদ বলেন, ইলিশের ভরা মৌসুম এখন। কিন্তু নদীতে তেমন ইলিশ নেই। যা ইলিশ সব সাগর এলাকার। তারপরও ইলিশ পেলে আমরা খুশি। আর দেড় মাস আছে ইলিশ ধরার সময়। এখন আমাদের সাগর-নদীতে বেশি থাকতে হবে।

ইলিশ ব্যবসায়ী কবির হোসেন বলেন, চাঁদপুরে মাছ ঘাটে ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে। যদিও স্থানীয় পদ্মা-মেঘনার জেলেরা এখনও কাক্সিক্ষত ইলিশ পাচ্ছে না। এ কারণে দাম কমছে না। বর্তমানে এক কেজি ওজনের ইলিশ ১৪০০-১৫০০ টাকা, ৭০০-৮০০ গ্রামের ১ হাজার থেকে ১১শ টাকা। আর দুই কেজি ওজনের ২ হাজার টাকা। এ ছাড়া চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনার ইলিশ কেজিতে ২০০-৩০০ টাকা বাড়বে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

বরিশাল : বরিশালের বাজারভর্তি সাগরের ইলিশ। জেলেরা বলছেন, নদীতে ইলিশ পাচ্ছেন না তারা। জাল ঠিকই ফেলছেন কিন্তু যে পরিমাণে পাওয়ার কথা সে পরিমাণে এ মাছ ধরা পড়ছে না। এ অবস্থায় মাছ বাজারের পরিস্থিতি গরম থাকার কথা। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সাগরের ইলিশের কারণে। বরিশালের বাজারগুলোয় নদীর ইলিশ না পাওয়া গেলেও সাগরের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। সাগরের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় মোকামে ইলিশের পরিমাণ বাড়ছে। গত এক সপ্তাহ থেকে দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে ছয়শ মণ করে ইলিশ নিয়ে ট্রলারগুলো পোর্ট রোডের মোকামে আসছে।

জেলেরা বলেন, এখনকার ভরা মৌসুমে নদী-সাগরে তেমন মাছ মেলে না। তবে কয়েক বছর আগেও ভরা মৌসুমে পোর্ট রোডের মোকামের আড়তগুলোয় দিনশেষে ২ হাজার মণ ইলিশ কেনাবেচা হতো। পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের মালিক-সমিতির অর্থ সম্পাদক ইয়ার শিকদার বলেন, আমাদের মোট ১৭০টি আড়তে এ ভরা মৌসুমে আগে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হলেও বর্তমানে বেচাবিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪০-৫০ লাখ টাকার। আড়তদারদের দাবি, নদী থেকে প্রায় শূন্যহাতে ফেরত আসছেন জেলেরা। তাই আড়তে নদীর ইলিশের দেখা মিলছে না। সাগর থেকে কিছু মাছ আসছে। ফলে মাছের দাম কিছুটা কমেছে। তিন-চার দিন পর নদীর মাছ পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তারা। শুক্রবার পোর্ট রোড বাজারে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ টাকা কেজি। ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশ ১৩০০ টাকা; ৫০০ গ্রামের এ মাছ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়।

ক্রেতারা বলছেন, ইলিশের দাম চড়া, যা তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ভরা মৌসুমে ইলিশের আকাল। লোকাল ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। সাগরের কিছু পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও দাম অনেক।