জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর

গণ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হতাশার মুখোমুখি

Sanchoy Biswas
এমএ মতিন
প্রকাশিত: ১১:১৪ অপরাহ্ন, ০৪ অগাস্ট ২০২৫ | আপডেট: ৬:১৪ অপরাহ্ন, ০৪ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া এক দফা স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আন্দোলন ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে এক দুর্লভ গণ-আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছিল, যা বহুপক্ষীয় দুঃশাসন, দলীয় দখলদারিত্ব, ভোটাধিকার হরণ এবং রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত জনবিস্ফোরণ ছিল। এই অভ্যুত্থান ছিল একটি জাতীয় জাগরণ—যেখানে নির্দলীয়, নিরাভরণ সাধারণ মানুষ রাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। তবে এক বছর পর, সেই আন্দোলনের বাস্তব অর্জন খুঁজতে গিয়ে আমরা মুখোমুখি হচ্ছি হতাশাজনক শূন্যতায়।

অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট: রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে নাগরিক বিদ্রোহ

আরও পড়ুন: জম্মু-কাশ্মীর: আলাদা পরিচয় থেকে জাতীয় মূলধারায়

২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিসরে বিরাজ করছিল এক ভয়ংকর অচলাবস্থা।

ভোটাধিকার ছিল বিলুপ্ত, নির্বাচন ছিল প্রতিযোগিতাহীন, অংশগ্রহণহীন।

আরও পড়ুন: তারেক রহমানের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠা, আর আমার কিছু কথা

স্বাধীন বিচারব্যবস্থা মূর্খ প্রহসনে পরিণত, দলীয় নিয়ন্ত্রণে পঙ্গু প্রশাসন।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দলীয় টুলবক্সে রূপান্তরিত।

বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষার বেহাল অবস্থা, বেকারত্বের হাহাকার, স্বাস্থ্যসেবা ধ্বংসপ্রাপ্ত—সব মিলিয়ে মানুষ ক্লান্ত, ক্ষুব্ধ এবং প্রস্তুত ছিল একটি চূড়ান্ত বিস্ফোরণের জন্য।

এই পরিস্থিতিতেই ছাত্র, কৃষক, নারী, দিনমজুর, চাকরিপ্রার্থী ও বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলনে গড়ে ওঠে এক নেতৃত্বহীন কিন্তু দিকনির্দেশনাপূর্ণ গণআন্দোলন—যা সরকার ও বিরোধী রাজনীতির একচেটিয়া দখলদারিত্বকে প্রত্যাখ্যান করে।

গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান দাবি ও আদর্শ

মূল দাবি

  • সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন
  • পিআর (PR) ভোটিং পদ্ধতির চালু
  • সংবিধান সংস্কার ও গণভোট
  • দলীয় পুলিশ-প্রশাসনের অবসান
  • নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
  • অর্থনৈতিক দুর্নীতির বিচার
  • রাজনৈতিক অপরাধীদের শাস্তি
  • নতুন নেতৃত্বের উত্থান

ব্যাখ্যা

  • বিদ্যমান সরকার ও দলীয় প্রশাসনের অধীনে নয়
  • দলীয় নিয়ন্ত্রণভিত্তিক মনোনয়ন ব্যবস্থা বাতিল
  • রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য জনগণের মতামত, জনগণের ক্ষমতায়ন
  • আইনের শাসনের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা
  • সরকারের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মুক্তি
  • লুটেরাদের শাস্তি ও অর্থ পুনরুদ্ধার
  • অতীতের খুন, গুম, ধর্ষণ, দখল ও দুঃশাসনের বিচার
  • ভাঙা রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে নতুন বিকল্প

সবচেয়ে বড় অর্জন: ভয়ের সংস্কৃতির অবসান

একটি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয় তখন, যখন মানুষ ভয়কে অস্বীকার করতে শেখে।

রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানুষ রাজপথে নেমে আসে।

দলনিরপেক্ষ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ খুলে বলে নিজের অভিমত।

এই ‘ভয়ের দেয়াল’ ভেঙে পড়েছে। এটি আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও, একটি রাষ্ট্রগঠনের পূর্বশর্ত এটি।

চেতনার জাগরণ ও নতুন প্রজন্মের প্রত্যয়:

গ্রাম-শহরে গড়ে উঠেছে নতুন রাজনৈতিক সচেতনতা।

শিক্ষার্থীরা এখন জানে, কীভাবে সংবিধান পরিবর্তন করা যায়, কেন পিআর (PR) পদ্ধতি দরকার, কেন দলীয় প্রশাসন রাষ্ট্রীয় বিপদ।

‘অরাজনৈতিক রাজনীতি’—এই নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে ২০২৪।

আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, আমেরিকা—সবাই ২০২৪-এর ঘটনাবলি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ গণজাগরণের আলোচনায় এসেছে।

কিন্তু বিদেশি স্বার্থসংশ্লিষ্টতা এবং রাজনীতির প্রতি তাদের দ্বৈত অবস্থান নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে দেয়নি।

প্রাপ্তি বনাম অপ্রাপ্তি: এক চোখে চাওয়া, অন্য চোখে কান্না

প্রাপ্তি

  • ভয়ের সংস্কৃতির পতন
  • রাজনৈতিক সচেতনতার প্রসার
  • আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ
  • নতুন রাজনৈতিক দল ও জোটের সূচনা
  • মিডিয়া ও সামাজিক আন্দোলনের জোয়ার
  • সুশীল সমাজের সক্রিয়তা
  • নাগরিক প্রতিরোধের বিস্তার

অপ্রাপ্তি

  • কাঠামোগত সংস্কারের অনুপস্থিতি
  • নির্বাচন পদ্ধতি অপরিবর্তিত
  • বিচারবিভাগে দলীয় নিয়ন্ত্রণ বহাল
  • দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্ব অক্ষত
  • প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও দলীয় দখলদারিত্ব
  • আন্দোলনের নেতাদের প্রতি অবহেলা
  • জনতার আত্মত্যাগের যথাযথ স্বীকৃতি নেই

ব্যর্থতার কারণগুলো কী?

১. নেতৃত্বের ঘাটতি: আন্দোলনটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হওয়ায় সংগঠিত রূপ নেয়নি।

২. পুরোনো রাজনীতির ছায়া: কিছু অংশ এখনো পুরোনো দলগুলোর স্বার্থে ব্যবহৃত।

৩. মিডিয়ার বিভক্তি: সাংবাদিকতা এখন দলীয় করায়ত্ত।

৪. আইনি কাঠামোর জড়তা: কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না হওয়ায় সবই এখন ‘পথের ধুলো’।

কী করা প্রয়োজন এখন?

পাঁচটি জরুরি পদক্ষেপ:

১. গণভোটের ভিত্তিতে একটি পূর্ণ সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন।

২. পিআর (PR) ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন।

৩. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও দলীয় নিয়ন্ত্রণের অপসারণ।

৪. দলীয় রাজনীতি থেকে প্রশাসন, পুলিশ ও প্রেসকে মুক্ত করা।

৫. রাজনৈতিক অপরাধের ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।

উপসংহার: এক বছরের একবুক হাহাকার, কিন্তু স্বপ্ন এখনো মরে যায়নি

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দল-মুক্ত, নেতৃত্বহীন এবং জনগণের মৌলিক চেতনার ওপর দাঁড়ানো এক বিপ্লবের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র এখনো অচল, দলগুলো এখনো দখলদার, আর নেতৃত্ব এখনো অনুপস্থিত।

তবু আশা হারানো যাবে না। এই অভ্যুত্থান ভবিষ্যতের রাজনীতিকে গর্ভধারণ করেছে—যার জন্ম এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

“গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়নি, বরং এটি এখনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক মুক্তির একমাত্র বীজ হয়ে রয়েছে।”

লেখক: এমএ মতিন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।