জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে

সারাদেশে পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা ও সেনা সদস্যরা সতর্ক অবস্থায়

Sanchoy Biswas
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৮:৩৪ অপরাহ্ন, ১০ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১০:০৯ অপরাহ্ন, ১০ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির রায় ঘোষণাকে ঘিরে দেশজুড়ে নিরাপত্তা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছে ১৩ নভেম্বর। জামায়াতে ইসলামী হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নভেম্বরে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবি মেনে না নিলে আজ ১১ নভেম্বর মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে। ফলে ১১ ও ১৩ নভেম্বর ঘিরে যেমন জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে, তেমনি সরকারও অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নভেম্বরে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবি মেনে না নিলে ১১ নভেম্বর মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে। এ ছাড়া আগামী ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় কবে ঘোষণা করা হবে, তা জানাতে আগামী ১৩ নভেম্বর তারিখ রাখা হয়েছে। এই মামলার অন্য দুজন আসামি হচ্ছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এর মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনকে রাজসাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: রাজধানীর সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার

এই দিনটিকে কেন্দ্র করে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকা লকডাউন কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় প্রচুর লোকের সমাগম ঘটিয়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা এবং গাড়িতে আগুন দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করাসহ নানা অপতৎপরতা চালানো হতে পারে। তাদের লক্ষ্য, সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট হুমকি না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব প্রচারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সে অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। তবে ক্ষমতাচ্যুতদের এই হুমকির বাইরেও অন্যান্য রাজনৈতিক হুমকিকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আওয়ামী লীগের এ ধরনের কর্মসূচির ডাক আগেও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। চোরাগুপ্তা ঝটিকা মিছিল করতে গিয়ে গত প্রায় ১০ মাসে ঢাকায় তিন হাজার নেতাকর্মী ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত ৩১ অক্টোবর ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়। এ ছাড়া ঘোষিত লকডাউন কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের নারায়ণগঞ্জ সদর থানা কমিটির সহসম্পাদক রাব্বী সরদারকে (২৫) দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে একটি সচল রিভলবারসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানায়, রাব্বীর মোবাইল ফোন থেকে দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য মিলেছে।

আরও পড়ুন: ইসির সিদ্ধান্ত অবৈধ, বাগেরহাটে চারটি আসন বহাল রাখতে হাইকোর্টের নির্দেশ

তবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা দল আওয়ামী লীগের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগামী ১৩ নভেম্বর ঢাকা লকডাউনের ডাক দেওয়া সম্পর্কে আইজিপি বাহারুল আলমের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার পালিয়ে গেছে গণমানুষের প্রতিরোধে। গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তাদের উৎখাত করা হয়েছে। এই পলাতক ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী আবারও যদি বিশৃঙ্খলা বা অপরাধ করার চেষ্টা করে, তাহলে জনগণই তাদের প্রতিরোধ করবে। দেশের জন্য, জনগণের নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কাজ করে এবং করে চলেছে। যেসব ফেসবুক পেজ থেকে পলাতক ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে, সেই পেজগুলো নিয়ে গোয়েন্দারা কাজ করছেন। এ ছাড়া তিনি অন্যদের সম্পর্কে আরও বলেন, আমাদের আইন মান্যতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ৯০ শতাংশ মানুষকে আইন-কানুন মানতে হবে, নিয়মমাফিক চলতে হবে। বাকি ১০ শতাংশ না হয় আইন মানবে না। তাদের মোকাবেলায় নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ কাজ করবে। কিন্তু আগে তো ৯০ শতাংশ মানুষকে আইন মানতে হবে। 

তিনি বলেন, স্বাধীনতা মানে এই নয় যে সামাজিক মাধ্যমে কাউকে গালাগাল করা। অথবা কারো রাস্তা বন্ধ করে রাখা। এগুলো প্রতিরোধে নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি পুলিশ ও সহায়ক অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তো আছেই। তিনি আরো বলেন, জনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধিতে বিস্তারিত বলা আছে। নির্বাচন বানচালের চেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে আইনসংগতভাবে যতটুকু যাওয়া দরকার, আমরা ততটুই যাব। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনুমানিক দেড় লাখ পুলিশ নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে।

এদিকে নাশকতা এড়াতে গতকাল সোমবার থেকে ঢাকার প্রবেশপথ, আবাসিক হোটেল, মেস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলে তল্লাশি ও বিভিন্ন অভিযান শুরু করেছে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হয়েছে। এর বাইরে সরকারি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। চেকপোস্ট ও টহল বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তালিকা ধরে ধরে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক নেতাকর্মীদের নজরদারিতেও রাখা হয়েছে। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন গোয়েন্দারা।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, বিচ্ছিন্নভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পরিচয় গোপন রেখে অবস্থান করছেন। সুযোগ পেলেই তারা সংগঠিত হয়ে ঝটিকা মিছিল করবে। তবে খুব বড়ভাবে একত্রিত হয়ে কোনো ধরনের নাশকতা করার সুযোগ পাবে না। কারণ সারা দেশেই পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা ও সেনা সদস্যরা সতর্ক রয়েছেন।

র‍্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, এগুলো উড়ো খবর। কনফার্ম কিছু না। গুজবে কান দেয়ার কোনো সুযোগ নাই। দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই র‍্যাবের গোয়েন্দা টিম ও সাইবার মনিটরিং টিম সবসময় তৎপর রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন পেজ ও আইডি থেকে এই ধরনের তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এগুলো দেশের বাইরে থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে তথ্য যাই হোক আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবো। কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটির কোনো কার্যক্রম করার সুযোগ নাই।

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী কোনো ধরনের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। ১৩ই নভেম্বর ঘিরে তারা মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে আলোচনায় আসতে যাচ্ছে।

পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন) রেজাউল করিম বলেন, আওয়ামী লীগকে কোনো ভাবে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না। কোনো মিছিল ও সভা করতে চাইলেও প্রতিহত করা হবে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ এই দলটির নেতাকর্মীর সন্ধান পেলে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।