কচুরিপানায় ভরা ধলেশ্বরী, বর্ষাতেও বন্ধ নৌপথ

মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ধলেশ্বরী নদী আজ মৃতপ্রায়। ভরা বর্ষার মৌসুমেও স্রোতের পানিতে ভরে ওঠার বদলে নদীর পুরো বুকজুড়ে এখন ঘন কচুরিপানার আস্তরণ। নৌকা, ট্রলার বা লঞ্চ—কোনো ধরনের নৌযানই চলাচল করতে পারছে না। দূর থেকে তাকালে নদী নয়, মনে হয় বিস্তৃত ফসলের সবুজ ভ’মি। এতে নদীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হাজারো মানুষের জীবিকা যেমন হুমকির মুখে পড়েছে, তেমনি এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও কার্যত ভেঙে পড়েছে।
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর ভাটিতে যমুনা থেকে উৎপন্ন হয়ে ধলেশ্বরী নদী মানিকগঞ্জের ঘিওর, সাটুরিয়া ও সিংগাইর হয়ে বংশীতে মিশেছে। প্রায় ১৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদী একসময় ছিল ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ—পশ্চিমাঞ্চলের জলপথ সংযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সিংগাইরের বায়রা—নয়াবাড়ী থেকে বংশাই পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটারজুড়ে প্রবল স্রোতের এই নদীতে চলত তিনতলা লঞ্চ ও স্টিমার। ধরা পড়ত রূপালি ইলিশ, বোয়াল, পাবদা। ভেসে উঠত শুশুকের খেলা, এমনকি ভয়ংকর কুমিরও ছিল নদীর প্রাণশক্তির প্রমাণ।
আরও পড়ুন: সাতক্ষীরা বিজিবির অভিযানে ১৪ বোতল ভারতীয় মদসহ প্রায় ছয় লক্ষ টাকার ভারতীয় মালামাল জব্দ
কিন্তু গত কয়েক দশকে মানুষের দখল, দূষণ ও অব্যবস্থাপনায় ধলেশ্বরী ধীরে ধীরে হারিয়েছে প্রাণ। নদীর দুই তীরজুড়ে গড়ে উঠেছে ইটভাটা, কারখানা ও বসতবাড়ি। শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সরাসরি নদীতে। প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা নদীর বুক দখল করে ভরাট করছে শাখা নদীগুলো। ফলে একসময়ের খরস্রোতা ধলেশ্বরী আজ কচুরিপানার কারাগারে বন্দী।
২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নদীর কাংশা থেকে ফোর্ডনগর পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার খনন করা হয়েছিল, ব্যয় হয়েছিল অর্ধ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু স্থায়ী সমাধান আসেনি। বরং আজ ভরা বর্ষায়ও হাঁটার মতো ঘন কচুরিপানা জমে আছে। কৃষকরা নৌকায় ফসল পরিবহন করতে পারছেন না, জেলেরা জাল ফেলতে পারছেন না, নৌযান শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
আরও পড়ুন: সাতক্ষীরা ভোমরা বন্দরে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৯৭৮ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নদী মরে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে সড়কপথ ব্যবহার করতে হচ্ছে, এতে ব্যয় বাড়ছে। জয়মন্টপ ইউনিয়নের ভাকুম গ্রামের সাহিত্যিক মুহাম্মদ কুদ্দুসুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আজ ভরা বর্ষাতেও ধলেশ্বরী মৃত। কচুরিপানা নদীর বুক ঢেকে ফেলেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল। নদী যদি না বাঁচে, এই অঞ্চলের জীবনও বাঁচবে না।
খাসের চর গ্রামের প্রবীণ আব্দুর রহমান বলেন, প্রশাসনকে বহুবার বলেছি নদী বাঁচাতে উদ্যোগ নিতে, কিন্তু পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেই। আগে ধলেশ্বরী ছিল জীবনের অংশ, এখন এটি দুর্ভোগের প্রতীক।
স্থানীয় জেলে সিদ্দিক মিয়া জানান, এই নদী আমাদের সব ছিল। আগে ইলিশ, বোয়াল, পাবদা—সবই পাওয়া যেত। এখন তিন দিন জাল ফেললেও এক কেজি মাছও পাওয়া যায় না। নৌকা কচুরিপানায় আটকে যায়। পরিবার চালানোই কষ্ট হয়ে গেছে।
চর দুর্গাপুর এলাকার বাসিন্দা মো. আমিনুর রহমান বলেন, সিংগাইর উপজেলার চর দুর্গাপুর এলাকায় মাত্র ২—৩ কিলোমিটার খনন করলেই নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তাই দ্রুত খনন জরুরি।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, বর্ষাকালে জমে থাকা কচুরিপানা অনেক সময় স্বাভাবিকভাবেই সরে যায়। অপসারণের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। তবে নদী সচল রাখতে আগামীতে খননের পরিকল্পনা রয়েছে।