নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁয়ে ২০০ বছরের পুরোনো কাইকারটেক হাট

Sanchoy Biswas
ইউসুফ আলী প্রধান, নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ৮:৫৭ অপরাহ্ন, ১০ অগাস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১০:৪০ অপরাহ্ন, ১০ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ হাটের ঐতিহ্য। তবুও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক কাইকারটেক হাটটি তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ছোট্ট মফস্বল শহরের বিশাল হাট—কাইকারটেক।

শুধু নিত্যপণ্যই নয়, এমন কোনো পণ্য নেই যা এই হাটে খুঁজে পাওয়া যায় না। টাটকা শাকসবজি থেকে শুরু করে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, বিভিন্ন মসলা, মাছ, গোশত, জেলেদের জাল ও জাল তৈরির সুতা, বাঁশ, কাঠ, নৌকা, লোহা ও বাঁশের তৈরি সামগ্রী, গৃহনির্মাণে কাঠ, পোশাক, বই, খাতা—কী নেই এখানে? পুরোনো দিনের হাটের সব বৈশিষ্ট্য এখানে রয়েছে। সপ্তাহে শুধু রোববার এখানে হাট বসে। সেই ভোরে হাট শুরু হয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে।

আরও পড়ুন: পটুয়াখালীতে সেনা-পুলিশের যৌথ অভিযানে গাঁজা ও ইয়ার গানসহ যুবক আটক

ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এই হাটটির চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই অপরূপ। এ হাটের প্রাচীনকালের কড়ই ও হিজল গাছগুলো যেন হাটের ২০০ বছরের বয়সকালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ৪০ বিঘা জমি জুড়ে বিস্তৃত এ হাটটি এখন অনেক ছোট পরিসরে চলে এসেছে।

উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়নের কাইকারটেক গ্রামে অবস্থিত কাইকারটেক হাট। এখানে বিক্রি হয় ঝালমুড়ি, বুট, পেঁয়াজু, নিমকি, চানাচুর, মোয়া—সহ নানা ধরনের লোকজ খাবার। এ ছাড়াও অনেক পদের মাছের শুঁটকিও এখানে খুব নামকরা। এখানে বাঙালি, শিবাজী, ময়ূরপঙ্খিসহ দামি দামি কবুতরও পাওয়া যায়। কোষা নৌকা, পুতা মিষ্টি, কাঠ, বাঁশ ও কৃষিজাত পণ্যের জন্য কাইকারটেক হাট নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় সুপরিচিত।

আরও পড়ুন: বাবা লেচু মিয়ার জনপ্রিয়তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন সৈয়দা আদিবা হোসেন

এই হাটের অন্যতম আকর্ষণ বিশেষ ধরনের মিষ্টি। সাধারণ মিষ্টির চেয়ে ওজনে এই মিষ্টি চার-পাঁচ গুণ বড় এবং স্বাদে অতুলনীয়। একেকটি মিষ্টির ওজন এক থেকে দুই কেজি হয়ে থাকে। দেখতে অনেকটা শিলপুতার মতো বলে একে ‘পুতা মিষ্টি’ বলা হয়। ২০০–২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় পুতা মিষ্টি। পুতা মিষ্টি ছাড়াও এই হাটে তালের রসা, কালোজাম, রসগোল্লা, জিলাপি, মোহনভোগ, লালভোগ, বালুশাহি—সহ নানা পদের মিষ্টি পাওয়া যায়।

হাটের আরেকটি বিশেষ পণ্য হচ্ছে কোষা নৌকা। বছরজুড়ে হাট বসলেও বাংলা সনের আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন—এই চার মাসই হাটে নৌকার দেখা মিলে। কম দামে ভালো মানের কোষা নৌকা বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ কাইকারটেক হাটে নৌকা কিনতে ভিড় জমায় নারায়ণগঞ্জের আশপাশ জেলার নৌকার শত শত ক্রেতা।

হাটে আগত কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, এই হাটটিতে সব জিনিসপত্রই পাইকারি দামে পাওয়া যায়। অনেক ব্যবসায়ী এখান থেকে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যায় তাদের দোকানে বিক্রি করার জন্য।

হাটে আসা সাইফুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালে থেকে বাবার সঙ্গে এ হাটে আসা শুরু হয়। আমার বাবাও দাদার সঙ্গে এ হাটে আসতেন। সাইফুল ইসলামের মতো আরও অনেকে যুগ যুগ ধরে এ হাটে আসা-যাওয়া করেন।

এই হাটে ৬৫ বছর ধরে শরবত বিক্রি করেন মজিবর রহমান। তিনি জানান, এই কাইকারটেক হাটটি পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসছে। তিনি এই হাটে ৬৫ বছর ধরে শরবত বিক্রি করে আসছেন। বর্তমানে বয়স হয়ে যাওয়ায় তার ভাগিনা আশরাফ উদ্দিন তাকে সঙ্গ দিয়ে থাকেন। ভাগিনা আশরাফ জানান, মামার সঙ্গে দোকানে আখের গুঁড়, লেবু ও বরফের মাধ্যমে সুমিষ্ট শরবত তৈরি করে বিক্রি করে আসছি সেই ছোট থেকেই। দূরদূরান্ত থেকে যারাই এই হাটে বাজার করতে আসেন তারা এই দোকানের শরবত না খেয়ে যান না।

আবদুর রহিম নামে কাইকারটেক হাটের এক কাঠ বিক্রেতা জানান, তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে কাঠ বিক্রি করেন। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতো নেই। যার কারণে কাঠের ব্যবসা এখন খারাপ যাচ্ছে। দীর্ঘদিন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ছেড়েও দিতে পারছেন না।

হাটের ইজারাদার রুমান বাদশা বলেন, এই হাটে নদের তীরে ঘাট নির্মাণ করা একান্ত দরকার। তা ছাড়া হাটে প্রয়োজনীয় শৌচাগার নেই। এ ছাড়া রয়েছে নানা ধরনের সমস্যা। এসব সমস্যার সমাধান হলে মানুষ হাটের প্রতি আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে বেচাকেনা করতে আসবে।