প্রশাসন ও পুলিশে স্থবিরতা কাটছে না

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দুই মাস পার হলেও জনপ্রশাসনে এখনও স্বাভাবিক কাজের গতি ফিরে আসেনি। পুলিশ এখনও আন্তরিকভাবে কাজ শুরু না করায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এছাড়াও সরকারের শীর্ষ পদগুলো দীর্ঘদিন শূন্য থাকায় নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তহীনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বতী সরকার গঠিত হলেও দুই মাসেও দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দলীয়করণে প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ নিয়ন্ত্রিত থাকলেও অর্ন্তবর্তী সরকার সে বলয় থেকে এখনও পুরোপুরি বের হতে পারেনি। পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে রদবদল করা হলেও মধ্যম পর্যায়ে এখনও স্বৈরশাসকের দোসররা বসে আছে। ফলে জনগণের প্রত্যাশিতভাবে কাজ বাস্তবায়নে ব্যঘাত সৃাষ্ট হচ্ছে। জানা গেছে এখনও শূন্য আছে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারসহ অধিকাংশ জেলা প্রশাসকের পদ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ দুই মাস ধরে শূন্য ছিল। জেলা প্রশাসক নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতি সচিবালয়ে হামলা-মারামারি প্রশাসনকে নজিরবিহীন বেকায়দায় ফেলেছে। এরই মধ্যে প্রশাসনে কর্মরত সচিব, মুখ্য সচিব, কেবিনেট সচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিবসহ অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ছাত্র গণহত্যার অভিযোগে মামলা ও গ্রেপ্তার প্রশাসনকে আরও গতিহীন করে দিয়েছে। সচিব ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভাগের বিশেষ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের দপ্তরের মহাপরিচালক-সহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় প্রধানের পদে পরিবর্তন না হওয়ায় তারাও স্বস্তিতে কাজ করতে পারছে না।সূত্র মতে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব নেই। এসব দপ্তরে দায়িত্ব পাওয়া অতিরিক্ত সচিবরা সচিবের রুটিন কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। মাঠ প্রশাসনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি)। প্রায় এক মাস ধরে আট জেলায় ডিসি নেই। এসব জেলার মধ্যে বিভাগীয় সদর জেলাও আছে। রাজশাহী বিভাগে আট জেলার চারটিতেই নেই ডিসি। এসব শূন্য পদ পূরণে তোড়জোড় নেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। কোথাও কাউকে পদায়ন করার পরই আদেশ বাতিল করার ঘটনাও ঘটছে। এদিকে, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদে দুটি ব্যাচের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতির অপেক্ষায়। পদায়ন ও পদোন্নতির কাজে দক্ষতা দেখাতে না পারলেও, উল্টো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা নানা বিতর্কে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছেন। বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এনিয়েও আছে সমালোচনা এবং অসন্তোষ। অনেকে বলছেন, অতীতের সরকারগুলোর পথেই হাঁটছে এ সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি অত্যন্ত ধীর। এসব মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি আনতে সংশ্লিষ্ট সচিবরা দক্ষতা দেখাতে পারছেন না। কেউ কেউ হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেরও একই দশা। অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঞ্চিত পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে কয়েক ধাপে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তাদের পদায়নও করা হচ্ছে। নতুন কর্মকর্তারাও সরকারি কাজের গতি বাড়াতে এখন পর্যন্ত তেমন সফল হননি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া ২২ জন সচিব এখনও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দায়িত্বে রয়েছেন। নতুন করে সচিব দেওয়া হয়েছে ২৬ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। গত ৮ আগস্টের পর সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে থাকা ১৭ জনের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে ওএসডি করা হয়েছে ১৫ জনকে। তাদের মধ্যে পাঁচজন সিনিয়র সচিব, ১০ জন সচিব। এছাড়া সচিব পদমর্যাদায় চুক্তিতে বিভিন্ন স্থানে কাজ করা আরও ১৮ জনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া গ্রেড-১ ভুক্ত এবং অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন স্তরের আড়াই শতাধিক কর্মকর্তা ওএসডি। সিনিয়র সচিব, সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এত কর্মকর্তাকে একসঙ্গে এর আগে কখনও ওএসডি করা হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তরে আগের সরকারের নিয়োগপ্রাপ্তদের ওএসডি করায় শীর্ষ পদ ফাঁকা রয়েছে। বর্তমানে তিন মন্ত্রণালয় এবং ছয় বিভাগে সচিবের পদ ফাঁকা। তিন মন্ত্রণালয় হলো তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সচিব না থাকা বিভাগগুলো হলো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, আইন ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, পরিকল্পনা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ। তিন দিন থেকে দুই মাস পর্যন্ত এসব পদ খালি। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগে সচিব পদমর্যাদায় একজন সদস্যের পদ ফাঁকা রয়েছে। সচিব ও ডিসি পদে নিয়োগের পরদিন বাতিল করা এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে কয়েকদিন পর বাতিল করার ঘটনা জনপ্রশাসনে ঘটছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান এ কে এম মতিউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়। গত ২ অক্টোবর তাকে করা হয় ওএসডি। খাদ্য ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইলাহী দাদ খানকে ৩০ সেপ্টেম্বর চুক্তিতে খাদ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরদিন তার নিয়োগ বাতিল করে সরকার। গত ১৪ আগস্ট জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মো. মোকাব্বির হোসেনকে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে বদলি করা হয়। ১৭ আগস্ট মোকাব্বিরকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে বদলি করা হয়। সিদ্ধান্ত নিয়ে অল্প সময় পরই বাতিল করায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বেশ আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। জানতে চাইলে এই মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, সচিবের কয়েকটি পদ শূন্য রয়েছে। এগুলো আমরা শিগগির পূরণ করব। তবে যোগ্য লোকের অভাব রয়েছে। তার পরও সচিব পদ বেশিদিন শূন্য রাখা ঠিক হবে না। এপিডি অনু বিভাগের একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, অনেক মন্ত্রণালয়ের কিছু উইংয়ে বেশি কর্মকর্তা থাকায় তারা বসার জায়গা পাচ্ছেন না। কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে পদ খালি আছে, সেগুলোতে পদায়ন করা যাচ্ছে না। কারণ, পছন্দের কর্মকর্তা ছাড়া তারা নেবেন না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, সচিব পদে পদায়নের শর্ত হলো কমপক্ষে এক বছর অতিরিক্ত সচিব পদে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সম্প্রতি উচ্চ পদগুলোতে পদায়নের জন্য নিয়োগবিধির শর্ত শিথিলের প্রস্তাব করা হলে তা অনুমোদন হয়নি। তাছাড়া জনপ্রশাসনে সার্বক্ষণিক উপদেষ্টা না থাকায় সব ক্যাডারের সব সমস্যা ও বিগত দিনে বঞ্চিতদের দাবির চাপ পড়ছে জনপ্রশাসন সচিবের ওপর। এতে সচিব চাপ সামলে দাপ্তরিক কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। ডিসি ছাড়াই চলছে আট জেলা: গত ১০ সেপ্টেম্বর ডিসি হিসেবে ৩৪ জেলায় নতুন নিয়োগ দেওয়ার পরদিন তাদের মধ্য আটজনের নিয়োগ বাতিল করা হয়। এক মাসেও এসব জেলায় কাউকে পদায়ন করা হয়নি। জেলাগুলো হলোÑ রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও দিনাজপুর। জানা গেছে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরা (এডিসি) রুটিন কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পি কে এম এনামুল করিমকে গত ৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরদিন এনামুলের নিয়োগ বাতিল করে সেখানে আরেকজনকে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে এনামুলকে ওএসডি করা হয়েছে। ডিসির শূন্য পদ পূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফ গণমাধ্যমকে বলেন, দ্রুত পদায়ন দিতে আমরা চেষ্টা করছি। আপাতত ডিসি নিয়োগে নতুন ফিটলিস্ট করা হবে না। যে ফিটলিস্ট আছে, সেখান থেকেই আটজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য যোগ্যতার মাপকাঠি অনুসারে কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের প্রস্তাব করা হলেও তা অনুমোদন হয়নি।
এদিকে পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষপদে রদবদল করলেও এখনও পলাতক রয়েছেন অনেক কর্মকর্তা। অনেক কর্মকর্তা কাজে যোগ দিয়েও গাছাড়া ভাব নিয়ে দায়িত্বপালন করছেন। এছাড়া রাজধানীসহ সারাদেশের ওসি নিয়োগ বা রদবদল করা হলেও তাদের মনোবল এখনও চাঙা হয়নি। গত জুলাই -আগষ্টের নিপীড়নে যেসব কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তাদের অনেকে গ্রেফতার হলেও এখনও অনেকে গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন। সব মিলিয়ে পুলিশের শৃঙ্খলা এখনও ফিরে আসেনি। এ সুযোগে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসীরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে দেশে খুন খারাপি বেড়ে গেছে।
আরও পড়ুন: বাধ্যতামূলক অবসরে সাতক্ষীরার সাবেক এসপি ও ডিএমপির ৯ ওসি